একুশের ভোর পত্রিকায় প্রকাশিত আমার গল্প "“ বাঙালি আগন্তুক”"


লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন


রেহান আমার সামনে ভাঙা চেয়ারে হেলান দিয়ে অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই থেকে থেকে হাত-পা নাড়াচ্ছে, জিভ বের করছে, মাথা নাড়ছে, আবার মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে কেউ বুঝতেও পারবে না যে আট-দশটা বাঙালি বাচ্চাদের মতো সে বাংলা বলতে পারেনা। এতে রেহানের অবশ্য কোনো দোষ নেই, দোষ আপা-দুলাভাইয়ের,বিশেষ করে আপার। হাজার হোক, মাতৃভাষা তো মানুষ মায়ের মুখেই শেখে। আমেরিকায় জন্ম বলে যে শেকড় ভুলে দমাদম ইংরেজিই শেখাতে হবে, এ কি কথা! রেহান ইতস্তত ভাব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে চোস্ত ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল,
“ So, you are my uncle? “

আমি ত্যালতেলে হেসে মাথা নুইয়ে সায় দিলাম যে আমিই তার হতভাগ্য মামা। হতভাগ্য বলার যথেষ্ট কারণ আছে। অনার্স শেষ করে যে ছেলে বাপের টাকায় টঙের দোকানে বসে চা খায়, মাঝে মাঝে দোকানের পিছনের দিকে গিয়ে সস্তা সিগারেটও টানে, তাকে হতভাগ্য বললে খুব একটা চোটপাট হবে না।

রেহানকে আমি এই প্রথমবারের মতো দেখছি। দুলাভাই আপাকে নিয়ে আমেরিকাতে গিয়েছিলেন বছর আটেক আগে, কাজের ব্যস্ততায় তাদের আর ফেরার সময় হয়নি। রেহানের জন্ম ওখানেই। জন্মের পর খবরটা আমরা পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু দেখতে পাইনি। একটা ফটো অবশ্য আপা দিয়েছিল, সেটা দেখার কৌতূহল হয়নি কখনো। আপন মানুষকে দেখতে হয় কাছ থেকে, অন্যভাবে দেখা মানে রক্তের বন্ধনকে অপমান করা, আমি আমার অজ্ঞাত সেই বন্ধনকে অপমান করিনি। হটাত করে আপা দুলাভাইয়ের আগমনে আমি যতটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে মা। মাঝে মাঝেই দেখছি মা রেহানকে কোলের ভিতরে জড়িয়ে রেখে গুলুগুলু মুলুমুলু জাতীয় অদ্ভুত সব ভাষায় রেহানকে আদর করছেন। দুজনের কেউ কারো ভাষা বোঝে না, কিন্তু স্নেহের ভাষার কাছে মুখের ভাষার অসারতা সেখানে স্পষ্ট দৃশ্যমান ! বাবাও মাঝে মাঝে ভাব জমাতে যাচ্ছেন বটে কিন্তু রেহানের উপর্যুপরি ইংরেজির কাছে বিপর্যস্ত হয়ে আলাপটা বেশিদূর আগাচ্ছে না।

আপার হটাৎ আসার কারণ বোঝা গেলো পরের দিনই। আপা বহু কষ্টে একখানা গ্রিন কার্ডের বন্দোবস্ত করেছেন, আমায় আমেরিকায় থিতু করার প্লান যে তার মাথায় যে বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। আপার বিয়ের পর ইনিয়ে বিনিয়ে এ নিয়ে অনেক কথা শুনেছি । বলাই বাহুল্য, বাবা মা কারোরই এতে দ্বিমত নেই। যে ছেলে রাত-দিন ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়ায় আর বাড়ি বসে বসে খায়, তার যদি একটা গতি হয় তাতে মন্দ কি! অনার্স পাশ ছেলে ওখানে মুটেগিরি করলেই বা কি, কেউ তো দেখছে না। বাঙালি যাই করুক, আরেক বাঙালি না দেখলেই চলবে। উপরন্তু তারা আরও বুক ফুলিয়ে পারবেন যে ছেলে-মেয়ে দুজনই আমেরিকায় থাকে, সেখানে কি করে সেটা জানা নিষ্প্রয়োজন।

বেশ কদিন হলো হাত ফাঁকা হয়ে আছে, বাবার কাছে আজকাল টাকা চাইতে ভয় ভয় করে। এদিকে রেহানকে ঘোরানোর দায়িত্ব ঘুরেফিরে আমার কাঁধেই পড়লো। আপা আমার কোলে ভাগ্নেকে গছিয়ে দিয়ে খোশগল্পে মজে গেলেন। নিরুপায় হয়ে শেষে বাবার শরণাপন্ন হলাম। আগে বাবার কাছে টাকা চাইতে দ্বিধা হতো, আজকাল আর হয়না। বরং খুব আগ্রহ সহকারে দেখি কিভাবে লোকটা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাঁচশ টাকা বের করেন, তারপর আবার কি মনে করে তিনশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে দুইশ টাকা বাড়িয়ে দেন। আজ অবশ্য নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলো, বাবা পাঁচশ টাকাই দিলেন, সাথে আরও দুইশ অতিরিক্ত দিলেন। সেই সাথে পই পই করে বলে দিলেন যেন রেহানের উপর কড়া নজর রাখা হয়। আমি যে নুলো প্রকৃতির এবং যেকোনো কাজে যে ছোটখাটো থেকে শুরু করে বড়সড় সকল ধরণের গোলমাল বাঁধিয়ে থাকি সেটা মনে করাতেও তার ভুল হলো না। রেহান কিছু বুঝলো না বটে, কিন্তু এই বৃদ্ধের শিশুসুলভ অঙ্গভঙ্গিমা দেখে সেও ফিক করে হেসে ফেলল।

শ্রাবণীর সাথে আমার দেখা হওয়ার প্রথম শর্ত হলো পকেট ফাঁকা থাকতে হবে। রফিকের ছোটবোন শ্রাবণী,এবার ইন্টারমিডিয়েট দেবে, আগেও অবশ্য দুবার দিয়েছে। পরিচয় এক ক্যাফেতে। সেদিন কফির দাম চুকাতে গিয়ে দেখি কোন এক দক্ষ শিল্পী সুনিপুণ ভাবে আমার পকেটে দুটাকার ব্লেড দিয়ে কারুকার্য করে মানিব্যাগখানা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। ফার্মগেটে বাসে ওঠার সময় কেন পশ্চাৎদেশে এতো ফুরফুরে হাওয়া লেগেছিল তখন বুঝলাম। আমার পিছনে এতক্ষণ ধরে কাটাকুটি করলো আর আমি কিচ্ছু টের পেলাম না! এদিকে ওয়েটার হারামজাদা বারবার এদিকে তাকাচ্ছে আর আমি বারবার ফাঁকা কাপে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চুমুক দেয়ার ভান করছি। কফির দাম দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত যখন ভাবলাম যে ক্যাশিয়ারের কাছে গিয়ে বলি,” জনাব, আমার টাকার থলে এক হারিয়ে গেছে, আপনাদের এখানে কি প্লেট মেজে মূল্য পরিশোধের নিয়ম আছে?” ঠিক সে সময় হঠাৎ শ্রাবণী উদয় হয়ে বলল, “আপনি মাহমুদ ভাই না?”। আমি সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বললাম, “ আপনার কাছে আড়াইশো টাকা হবে?” মেয়েটা অবাক হয়ে পার্স থেকে তিনশ টাকা বের করে দিল। আমি আড়াইশো টাকা চুকিয়ে বাকি টাকা নিজের পকেটে চালান করে দিয়েছিলাম। যদি জানতাম সেই তিনশ টাকার ঋণ সুদে আসলে ফুলে ফেঁপে এমন হবে তাহলে হয়ত টাকাটা ফেরত দিতাম।

আজ প্রথমবারের মতো সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো, শ্রাবণীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। শ্রাবণী কাঁদলে চোখের পাতা টকটকে লাল হয়ে ফুলে থাকে, এখনো ফুলে আছে। তার চেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, কাঁদলে শ্রাবণীকেও ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর দেখায়। শ্রাবণীর সাথে হাঁটার সময় আমার প্রায়ই কাঁদানোর এই ভয়ংকর ইচ্ছাটা হয়, আমি বহু কষ্টে নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখি। শ্রাবণী আমার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল, রফিকের মুখে হয়ত যে আমার বিদেশ যাবার খবর শুনে থাকবে। আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ ভালো আছো শ্রাবণী? তোমার পড়াশোনা ভালো হচ্ছে?” শ্রাবণী আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রেহানকে কোলে তুলে নিলো, রেহান আপত্তি করলো না। সুন্দরীদের আহ্বান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারো নেই, বাচ্চারও না, বুড়োর না।

মোদাচ্ছের মিয়া গাবতলি বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পার্শ্বে বসেন সপ্তাহে ছয় দিন। এই জায়গাটা তার জন্য একেবারে পাকাপোক্ত, একেবারে নট নড়ন চড়ন অবস্থা, যদিও সেজন্য ট্রাফিক সার্জেন্টকে দিনে সত্তুরখানা টাকা গুনে দেয়া লাগে। তার পেশা যদিও খুব একটা মহৎ না, সোজা বাংলায়, তিনি ভিক্ষা করেন। সপ্তাহে ছয়দিন এখানে ভিক্ষা করার পর শুক্রবার পুরান ঢাকায় যান, সেখানে তার পুরো পরিবার থাকে। মোদাচ্ছের মিয়ার সাথে আমার কিভাবে পরিচয় পানের পিকে। মোদাচ্ছের মিয়ার আবার পান খাওয়ার বাতিক আছে, তার মতে জর্দা দিয়ে পান খেলে ঝিমুনি আসে আর তাতে ভিক্ষা ভালো হয়। সেবার এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কোথা থেকে পানের পিক এসে প্যান্টে পড়ল। পাশ থেকে মোদাচ্ছের মিয়া জিভ কেটে বলল,“মাফ করি দেন ব্রাদার, ভুল করি মিসটেক হয়ি গেছে” একজন ষাটোর্ধ ভিক্ষুকের মুখে ব্রাদার ডাক শুনে আমিও ভুল করে মোদাচ্ছের মিয়ার পাশে বসে মিসটেক করে ফেললাম।

 মোদাচ্ছের মিয়াকে আমার বিদেশ যাবার খবর দেয়া দরকার। মোদাচ্ছের মিয়া মাঝে মাঝেই পাম খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে বলত, “ আমার মতোন বইয়া যান ভাইজান, স্ট্যান্ডের ওইহানে বইবেন, টেহায় টেহা। খালি একটু মেকাপ লাগত।” মোদাচ্ছের মিয়ার অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি, একদিন তার কথামতোই মেকাপ হলো। ডান চোখ বন্ধ করে, এক হাত পোলিও রোগীর মতো ভঙ্গীতে মোদাচ্ছের মিয়া নিজে আমাকে সাজায়ে দিলেন।
“ভাইজান, খালি গড়াগড়ি দিবেন, ডাইনে দুপাক, বায়ে দুপাক। আর মাইয়ালোকের আশেপাশে বেশি যাইবেন। মাইয়াগো দরদ বেশি, ভালোমতো গড়ান দিবার পারলে টেহা বেশি পাওয়া যায়। একবার পাক মাইরা দেহান দেহি!”
আমি শুয়ে শুয়ে বার ছয়েক গড়াগড়ি দিলাম। মোদাচ্ছের মিয়ার মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটল, অভিনয় ভালো হয়েছে। সেদিন দুপুরে আমায় হাসপাতালে নেয়া হলো। গড়াগড়ি দেয়া ফকির যদি ভিক্ষা নেয়ার সময় হাঁটুতে ভর দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ায় তবে তার আস্ত থাকবার কথাও নয়। মোদাচ্ছের ফকির বারদুয়েক ঘুরেও গেল, প্রত্যেকবার হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বিছানার কাছে এসে বলত,“ ভুল করি কি একখান মিসটেক কইরা ফালাইলেন ভাইজান! এহন শরিলডা কেমুন?”
আমার শরীর তখন ভালোর দিকে, কিন্তু হাসপাতালে এসে যদি কেউ শোনে রোগী দিব্যি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে হেঁটে বেড়ায় তবে তাতে আশাভঙ্গ হওয়া স্বাভাবিক। আমি খুব অসুস্থ, হাত পা নাড়াতে পারছি না এমন ভঙ্গীতে কাতর গলায় বললাম,“ভালো”। মোদাচ্ছের মিয়াকে দেখে বোঝা গেলো তার আশাভঙ্গ হয়নি।
“ যে মাইরডা দিল আপনেরে! পাও দুইহান এক্কেরে ভাইঙ্গা দিছে। চিন্তা লইয়েন না, লইত্যাবুড়ির তেলপড়া আইন্যা দিমু, একদিনে বাত-ব্যথা ক্লিয়ার।”
লইত্যাবুড়ির তেলটা এখনো নেয়া হয়নি, সেটা নিতেই রেহানকে নিয়ে মোদাচ্ছের মিয়ার আস্তানার দিকে যাওয়া। মোদাচ্ছের মিয়াকে দেখেই বোঝা গেলো তিনি এখন প্রচন্ড ব্যস্ত। আমাদেরকে দেখে থামার ইশারা করলেন। রেহান বোধহয় এর আগে বাংলাদেশি ভিক্ষুক দেখেনি, সে বেশ কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে মোদাচ্ছের মিয়ার গড়াগড়ি দেখল।
“ ভাইজান, আপনার লগে এইড্যা কেডা?”
আমি রেহানের হাত ধরে বললাম,“আমার ভাতিজা”
রেহান তখনো মোদাচ্ছের মিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, একটু আগে যে লোক রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছিল সে এখন বেঞ্চে বসে চুকচুক করে চা খাচ্ছে এটা সে ঠিক হজম করে উঠতে পারছেনা। অনেকটা কৌতূহলী হয়েই সে বলল,“ Are you a begger?”
মোদাচ্ছের ফকির সবে চুমুক দিচ্ছিলেন, রেহানের কথা শুনে বিষম খেয়ে রেহানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন ।
“ভাইজান! পোলায় দেহি ইংরেজি কয়! কন কি! বাংলা কইবার পারে না! বরফ খ্যাইবা? বরফ কিইন্যা দেই?” মোদাচ্ছের মিয়াকে ঠেকানো গেলো না, তিনি ৫ টাকার দুটো রঙ্গিন আইসক্রিম কিনে আমাদের দুজনের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি বারদুয়েক চুষে সেটা ফেলে দিলেও রেহানকে বেশ আগ্রহ সহকারেই খেতে দেখা গেল।

রায়েরবাজারের পিছনের বস্তিতে ঘুপচির মধ্যে ছালা দিয়ে বানানো খোলা যে হোটেলটাতে আমরা বসে আছি তার নাম “ তৃণকুটির”। কোনো এক ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের ভাই আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে এবারের ভোটে জয়ী হলে তিনি আগের বারের মতোই প্রতিশ্রুতি রাখবেন। সেই ব্যানারের অপর পাশে কয়লা দিয়ে বড় বড় করে ‘তৃণকুটির’ লেখা হয়েছে, লেখাটা সুন্দর দেখাচ্ছে । বস্তি এলাকায় এমন শৈল্পিক নামের কোনো হোটেল থাকার কথা নয় কিন্তু এখানে আছে। দোকানের মালিক লতিফ সাহেব ধার্মিক মানুষ,সম্প্রতি সাদা দাড়িতে মেহেদি দিয়ে কলপ করেছেন, কপালে জ্যোতিটিকাও পড়েছে। তৃণকুটিরের বিশেষ দিক হলো এখানে মাটির হাড়িতে ভাত রান্না হয়, আবার লতিফ সাহেবের হাতে দুশো তিনশ টাকা ধরিয়ে দিলে ক্যাশবাক্সের নিচ থেকে রঙ-বেরঙের বোতলও বেরিয়ে আসে। লতিফ সাহেবেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অবশ্য বেশ অমায়িক হয়ে যুক্তি দেখান।
সেবার আমি বেশ কৌতুহলের সাথেই জিজ্ঞাসা করলাম,
“ লতিফ সাহেব, এই বোতলে আপনার পাপ হবেনা?”
লতিফ সাহেব সাথে সাথে উত্তর দিলেন না, খুব সুন্দর করে হাই তুলে ক্যাশবাক্স থেকে আতরের শিশি বার করে আমার হাতে বার দুয়েক ঘষে দিলেন। তারপর দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “ কষ্ট দেয়াও তো ভাইজান গুনাহ। বেবাগ মানুষ আছে, হেরা এইসব না পাইলে কষ্ট পায়।” অকাট্য যুক্তি, আমি মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম, “ তা ঠিক”।

তৃণকুটিরে ভাত-মাছের অর্ডার দেয়া হয়েছে, লালটু এসে গরম খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। লালটুর বয়স বছর ছয়েক হবে, পরনে গেঞ্জি আর মারাত্মক রকমের ঢিলা প্যান্ট, যখন তখন কোমর বেয়ে নেমে আসবে এমন অবস্থা। লালটুর আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সারাবছর তার নাকে সর্দি লেগে থাকে। রেহানআড়চোখে লালটুর দিকে তাকিয়ে চামচ দিয়ে খেতে লাগলো। তার চেয়ে ছোট একটা ছেলে নির্বিকার ভঙ্গীতে বসে জিভ দিয়ে নাকের সর্দি চাটছে, এটা তার কাছে একেবারেই নতুন।

বিকালে শহীদ মিনারে বেশ ভিড় থাকে । নববিবাহিত থেকে ক্ষণস্থায়ী, সকল ধরণের দম্পতির আনাগোনা চোখে পড়ে। অনেকে আবার বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতেও আসে। আমি রেহানকে নিয়ে একটা সিঁড়ির উপরে বসলাম।
রেহানের চোখ শহীদ মিনারের দিকে, চোখ না সরিয়েই বলল, “ This is The Saheed Minar, right?”
আমি অবাক হয়ে মাথা নাড়লাম, রেহান আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে তাকিয়ে হাসল । আমি ইংরেজিতে রেহানকে জিজ্ঞাসা করলাম,
“ তুমি এ ব্যাপারে জানো?”
“ We had a session on Language Movement in our school. Mom taught me this song…..”

আমি চমকে উঠলাম! রেহান ভাঙা ভাঙা বাংলায় গান গাইছে, সে বাংলা বোঝা না গেলেও স্পষ্ট এটুকু বোঝা যাচ্ছে গানটা কি। বিকেলের আলো তখন ফিকে হয়ে এসেছে, রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর সিড়িতে বসে এক শিশু ভাঙা ভাঙা বাংলায় মধুর সুরে গাইছে, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।

আমি আমেরিকা যাচ্ছি না শুনে আপা রীতিমতো তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে বসেছে, আমায় না নিয়ে সে এই বাড়ি থেকে এ পা নড়বে না বলে প্রতিজ্ঞাও করেছে শুনলাম। আপা খুব ভালো করেই জানে সে আমায় নিয়ে যেতে পারবে না। আমার দেশ আছে, মা আছে, মোদাচ্ছের মিয়ার মতো অসংখ্য রক্তের বন্ধনবিহীন প্রিয়জন আছে। আমি পরগাছা নই, আমার শেকড় আছে। এই শেকড়ের মায়া ছেড়ে দূরে যাওয়া আমার পক্ষে কখনই সম্ভব না।

আমি জানি, হয়ত কোনো একদিন আমার আর শ্রাবণীর রেহানের মতো ফুটফুটে এক সন্তান হবে। আমি চাইনা আমার সে সন্তান চিজবার্গার আর হটডগ খেয়ে বড় হোক, আমি চাই সে গরম ভাপ ওঠা ভাতের উপর গাওয়া ঘি এর সুবাস পাক। আমি এ ইচ্ছা নেই যে সে বেসবল খেলে দিনে দুবার হিপ হিপ হুররে বলে হাঁক পাড়ুক, আমি চাই সে বাঁশের বানানো ব্যাটে ক্রিকেট খেলে গো হারা হেরে কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে বাড়ি আসুক। আমার এ ইচ্ছা নেই যে আমার সন্তান লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণ আগাগোড়া মুখস্ত বলুক, আমি চাই সে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণ শুনুক। স্কুলে গিয়ে প্রতিদিন ‘Make America great again’ বলার কোনো প্রয়োজন আমি দেখিনা, আমার সন্তানের জন্য ‘জয় বাংলা’ই যথেষ্ট। আমার সন্তানের কোনো কিংবদন্তীর সংস্পর্শ প্রয়োজন নেই, আমি চাই সে একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের গল্প শুনুক। আমার সন্তানের জন্য বিলাসী চাকচিক্যময় জীবনের প্রয়োজন নেই, আমার ইচ্ছা সে দারিদ্র্যকে খুব কাছ থেকে দেখুক। আমার সন্তানের জন্য কোনো Fairytale Session এর প্রয়োজন নেই, আমার অশীতিপর বৃদ্ধ নানির ‘রাখালের পিঠে গাছের গল্পে’ই তার মন ভরে যাবে। শেক্সপেয়ারের সনেট চোস্ত ইংরেজিতে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি চাই আমার সন্তান জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ পড়ুক, Romeo and Juliet পড়ে মন খারাপ করার চেয়ে ‘পথের পাঁচালি’ পড়ে কাঁদতে শিখুক। আমি চাইনা আমার সন্তান দায়সারা আমেরিকানদের মতো প্রতিদিন বলুক, Dad, I love you, আমি চাই আমার সন্তান কোন এক বৃষ্টির রাতে জবুথবু হয়ে আমার বুকের কাছে শুয়ে ঘুমন্ত আমি’র কানে নিঃশব্দে বলুক, “ভালোবাসি বাবা”।

(সমাপ্ত)

                                    

Comments

Popular posts from this blog