কবিতাঃ আমি সেদিনই বখে গিয়েছিলুম

                                                                 আসিফ মাহমুদ জীবন



মতির দোকানে সেদিন হিঙরে কচুরি চলছে,
ডুবো তেলে ভাজা, দেখলেই জিভে জল আসে
বিশ্বাসের ছেলে আধ-খাওয়া কচুরি এক শীর্ণ বোষ্টমির মুখে ছুড়ে বলেছিল,‘লে কুত্তা, খা!’
আমি তখনই লিকলিকে দেহ নিয়ে বিশ্বাসের সেই ষণ্ডা ছেলেকে দুপ্রস্থ ঠেঙিয়েছিলাম,
আমি জানি, আমি সেদিনই বখে গিয়েছিলাম।

সাইজির গান হয় প্রতি রাতে, আড়ঙের ঘরে প্রাণ জ্বলে একতারায়;
ধোয়া ওড়ে না, বোতল গড়াগড়ি যায় না, মাদক ঐ একখানাই, একতারার গান!
বাবা বললে,‘ওসব ফকিরে কাজ, ছোটলোকের জাত বিকানো’
সে রাত্তিরে আমার ঘর ফাঁকা রইল, আমি তখন সাইজির গানে ঢুলছি;
আমি বেশ জানতুম, আমি সেদিনই বখে গিয়েছিলুম।

গল্প পড়ায় সেবার খুব নেশা ধরে গেল,
রবীন্দ্র আর বঙ্কিম মিলে রক্তে সৃজনের নাচন জাগাল;
পাশের বাড়ির কাকা এসে বাবায় সুবুদ্ধি দিলে, ‘ ছেলের মতিগতি তো সুবিধার নয়, ঘাড় গুঁজে ওসব কি পড়ে! জব্দ করো ক্ষণিকে! কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।’
বাবা সব বুঝলে, আমার বই বন্দী হলো রঙ্গিন কাঠের ফ্রেমে;
যেদিন সাহিত্যের নেশার টানে তালা ভেঙে প্রথম বই ছুঁয়েছিলুম
আমি আজ অব্দি জানি, আমি ঠিক ঐ দিনই বখে গিয়েছিলুম।

চারমিনার আমার একেবারেই চলত না,
গন্ধের শ্রী দেখেই গা জ্বলে উঠতো
অরুনা যেদিন হাতে কার্ডখানা দিয়ে হাসিমুখে বলেছিল,‘এসো কিন্তু! তোমার কাছে উপহার চাইনে, একবারটি শুধু খেয়ে যেও।’
সেদিন চারমিনার মৃদু হেসে বলেছিল-‘শেষমেশ আমাকেই তো কোল দিতে হলো? পোড়াবেই যখন, আগুনের জাত নিয়ে তখন এতো দেমাগ কেন?’
আমি দিব্যি জানি, ঐ আগুনের দেমাগে, আমি ঐ দিনই বখে গিয়েছিলুম।

জালালের ছেলে সেবার বাড়ি এসেছে,
গলির মোড়ে একা সুলতানার হাত পাকড়ে বীভৎস গলায় বললে,‘আমার ঘরে চ! কথা আছে’
সুলতানা যেতে চাইলে না, আমি ঘাড় ধরে জালালের ছেলেকে সেবার উঁচিয়ে ধরেছিলুম;
সুলতানা আমায় ধন্যবাদ বলেনি, তার চোখে ছিলো আদিম এক আবেগ, ভয়!
ছুটন্ত সেই সুলতানাকে দেখেই বুঝেছিলাম, সেই ভয়ে আমি সেদিনই বখে গিয়েছিলুম।

দেশ নাকি ভাগ হবে! এ কেমন অদ্ভুত কথা!
মায়ের আবার ভাগ কিরে!
নরেশ কাকা ওপারে যাবে? কেন? এপারে বুঝি জাতরক্ষা হয় না?
কিসব পার্টি এসেছে মহল্লায়! পালা করে হিন্দুর বাড়ি কড়া নাড়ে, লম্বা করে বিকৃত সালাম দেয়।
একবার আমার সামনে রমনা বৌদির গায়ে হাত দিল, বুঝলুম, আমার জাত গেলো;
না! শুধু মুসলমানের না! আমার মানুষ জাতটাই গেল!
পার্টির সেই চ্যাংড়া জানোয়ারকে হুড়কো মেরে শ্রীমতী বিলে চুবিয়েছিলুম,
বাড়ি বাবার রক্তচক্ষু দেখেছিলুম না?
হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি বোধহয় ঐ দিনই বখে গিয়েছিলুম।

যে ভাষায় কথা কইছি সে নাকি মালাউনের মুখের পাপ!
উর্দুয় কথা কইলে নাকি শরীর পাক হয়!
নজরুলের গান তখন আর শোনা যায় না, মোদাচ্ছের হাজীর সেই রেডিওতে তখন অল পাকিস্তান রেডিও’র ঠনঠনা উর্দু বাজে। উর্দুতে ‘শুওর কি অলাদ’ শুনলেও তখন তাদের পুণ্য হয়।
আমার কেন জানি ফাঁকা ঠেকল, ছ’ক্রোশ ডিঙিয়ে রেডিও কিনে আনলুম।
সেই রেডিও তখন পাখির মতো বাংলা বলে, যেন খোলা আকাশে ছাড়া পেয়ে বাতাসে শিস বাজায়!
দরজায় কড়া পড়ে, হাজীর কথায় নাফরমানি! এতো সাহস!
আমি গা করিনি, রেডিও বাজে, পুবের বাতাস বয় আর দরজার খোলা শেকলখানা নড়িয়ে জানান দিয়ে যায়, পাখি আজ মুক্ত!
খুব সম্ভবত ঐ মুক্তির দিনই আমি বখে গিয়েছিলুম।

দুযুগ কাটে, রক্তের তেজ তখনও ঝাঝালো, গ্রিবা সুউচ্চ
আবার, সুজনদা ছোটে, পেছনে কোলের মেয়েটি নিয়ে বিশাখা বৌদি,
জলিল ছোটে, মতি চাচা ছোটে; পিপড়ার সারির মতো মানুষ ছোটে।
চারদিক তখন খাকি পোশাক , মনে হয় যেন শেয়ালের গায়ে কে যেন মাড় ঢেলে দিয়েছে
সেসব শেয়ালের হাতে লম্বা লাঠি থাকে, লাঠি দিয়ে উত্তপ্ত সীসা বেরোয়।
সেলিমের পুকুরটা লাল হয়ে যায়, কাছে দাঁড়ানো যায় না দুর্গন্ধে।
শ্রীমতির স্রোতে তখন লাশ ভাসে, হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা
আমি নড়ে বসলুম, খাকির গুষ্ঠি উদ্ধারে বেরিয়ে গেলাম অন্ধকারে
শেয়ালের দল বাবায় এসে জিগালে, ‘ তোর পোলা কই?’
বাবা সেই প্রথমবার পরম তৃপ্তিতে হেসে বললেন, ‘‘বখে গেছে’’
মায়ের পাঠানো লাল ভেজা চিঠিখানা পেয়ে আমি হয়ত প্রতিজ্ঞা করে সেদিনই বখে গিয়েছিলুম।

অশীতিপর আমি আজও ভেবে পাইনে, আমি ঠিক কবে বখে গিয়েছিলুম।
আমি জানি আমি মাথা তুলেছি, অমন প্রাণভরে বাংলা বলেছি, গানে সুর তুলেছি বলেই আমি বখে গিয়েছিলুম।
আমি বখে গিয়েছিলুম কারণ আমি জানতুম সমাজে আমার মতো বখাটেরাই অন্যায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, অন্যায়ের পেশি মুচড়ে দেয়,
আমি জানতুম এই বখাটেরা কোনো শাসক মানে না, মুখে কোনো লাগাম রাখে না।
তাই প্রত্যহ সময়ের ফেরিয়ালার ঝুড়ি তন্নতন্ন করে আমি ঐ একটা উত্তরই খুঁজি, আমি কি ঠিক সেদিনই বখে গিয়েছিলুম? 
(সমাপ্ত)
                                                   


Comments

Popular posts from this blog