আমার নানাভাই
আসিফ মাহমুদ জীবন
গতকাল আমার নানার তেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। আমার নানা যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স সাড়ে চার ছুই ছুই। বিকেলবেলা তাকে মাইক্রোতে উঠিয়ে মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হলো, তিনি রাতে বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। সেই রাতে আমায় কেউ ডাকেনি, আমি নিজেই উঠেছিলাম। মধ্যরাতে চার বছর বয়সি কোনো শিশু যদি ঘুম থেকে উঠে দেখে যে বারান্দার মেঝেতে তারই সর্বক্ষণের বন্ধু নিথর হয়ে শুয়ে আছে আর তাকে ঘিরে পরিচিতরাই গগনবিদারী চীৎকার দিয়ে রাতের আকাশ বাতাস ভারি করে ফেলছে, সেটা আর যাই হোক সুখকর দৃশ্য নয়। আমি অবাক হতে পারিনি, শিশুরা সহজে অবাক হয় না। খুব চুপচাপ হয়ে আমি বারান্দায় ঠেস দিয়ে বসে নানার দিকে তাকিয়েছিলাম, নানার মুখে তখনও সেই শান্ত সৌম্য হাসি। মৃত্যুও সে হাসির সৌন্দর্য ম্লান করতে পারেনি। প্রচণ্ড বিলাপের মাঝে সেই হাসি দেখে আমি কখন সেই রাতে ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা আমার নিজেরও মনে নেই।
নানাকে গ্রামের মানুষ
জানতেন মিলিটারি নামে। মুক্তিযুদ্ধের পর তার সেনাবাহিনীতে যোগদানের কারণেই সম্ভবত
এমন নামকরণ। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে মুদির দোকান, হেন কোনো কাজ নেই নানা করেননি।
আবার যুদ্ধের সময় ঠিকই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। নানার খুব সুখ্যাতি ছিল হাসি
খুশি মানুষ হিসেবে, গ্রামের মানুষ তীব্র অভাব অনটনেও তাকে হাসতে ভুলতে দেখেনি।
আমার বাল্যকালের
অধিকাংশ সময় আমার সাথে ওই নানাই ছিলেন। রাত্রিবেলা খেতে না চাইলে আমায় নিয়ে সারা
গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন। দুঃসাহস জিনিসটা বোধহয় তখন থেকেই জন্মানো শুরু। শুক্রবার নিয়ম
করে সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমায় বাজারে নিয়ে যেতেন। আমায় চা খেতে দেয়া ছিল মায়ের
পক্ষ থেকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নানাভাই তা মানতেন না, আগেই চায়ের দোকানে গিয়ে আমায়
ফু দিয়ে দিয়ে চা খাওয়াতেন। সেই ছোট্ট আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, এই মানুষটার কাছে
যে আবদারই করা হোক সে ফেলতে পারবে না।
আমার মায়ের তখনই
পিটিআই ট্রেনিং চলছে। ট্রেনিং হবে জেলাশহরে, সেখানে তো আর সবার থাকা চলে না। অনেক ভেবে চিনতে আমাকে মায়ের কোলে দিয়ে নানিসহ
পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হল। সেদিন রাত্রে কোয়ার্টারের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ, নানি দরজা
খুলে দেখলেন সেই মধ্যরাতে নানা এসেছেন। নানি অবাক হয়ে বললেন, “ সে কি গো! জানতাম
তো নাতির টানে ঠিকই আসবা, কালকে আসা যেতো না? এই রাত্তিরবেলা!” নানা লজ্জিত হয়ে
বাইরে দাড়িয়েই বললেন, “ নানাভাই কই? ঘুমিয়ে পড়েছে?” । নানি সেই রাতে সারারাত
নানাকে টিপ্পনি কেটেছেন, শেষে অতিষ্ঠ হয়ে নানা সিদ্ধান্ত নিলেন ভোর হলেই চলে
যাবেন। ভোর হলো, নানা বেরিয়ে গেলেন এবং ঠিক আধাঘন্টা পর নানা ফিরে এসে আমার পাশে
বসে বললেন,“আর দুটো দিন থেকে যাই।” এই ছিল আমার নানার কেমিস্ট্রি।
নানাকে গ্রামে কবর
দেয়া হলো না, কবর দেয়া হলো পাশের গ্রামের কারবালায়। বাঁশের ফালি আর চাটাই দিয়ে
কবরখানা ঢেকে দেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে আমি শেষবারের মতো নানাকে দেখেছিলাম, নানার মুখে
তখন সেই হাসি আর নেই। কি জানি, হয়ত বুঝেছিলেন আমার সাথে তার এই শেষ দেখা।
সেই কারবালাটা এখন আর
নেই, সেখানে এখন আর নানার কবর চেনা যায় না। সেখানে এখনও সেখানে কালবিছুটির ঝোপ
ছড়ানো, বাতাসে আজো সেই ভারি ভারি ভাব, শুধু কবরটার হদিস মেলেনা। যখনই গ্রামে যাই, কারবালাটার এ প্রান্ত হতে
ওপ্রান্ত আমি ছুটে বেড়াই, স্মৃতির খোঁজে, পরমাত্মার খোঁজে, একটা ডাকের খোঁজে।
পৃথিবীতে প্রত্যেক
মানুষের শৈশবের একটা শ্রেষ্ঠ উপহার থাকে, আমার শৈশবের শ্রেষ্ঠ উপহার আমার নানা।
না, তার সব স্মৃতি আমার মনে নেই। কিন্তু সেই ঘন অন্ধকারে ঘাড়ে চড়ে পুরো গ্রাম ঘুরে
বেড়ানো, সাইকেলের সামনে বসে দুজনের খিলখিলেয়ে হাসি, বেয়ারিং দিয়ে ঠেলাগাড়ি বানানো,
একই চায়ের গ্লাসে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়া, এগুলো ভুলবার নয়, আমি নিজেকে ভুলে যেতে
দেবো না। আমি জানিনা নানাভাই তুমি কোথায় আছো, আমি শুধু এটুকু জানি, তুমি ভালো আছ।
(বামে নানা, মাঝে
মামার কোলে আমি, ডানে নানি। নানার একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন বলতে এটুকুই)
Comments
Post a Comment