গল্পঃ নরকের ফুল

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

পর্বঃ১ম পর্ব

“ কাইল রাইত্তেও তুমারে ফের মারছে , না?”
পুঁইশাকের পাতা ছিঁড়তে গিয়ে পিছন থেকে এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে ওঠে লালবানু। পিছনে ফিরে দেখে ফিরোজার মা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাথায় আঁচল দিয়ে সামান্য হাসার চেষ্টা করে লাল বানু। কিন্তু ফিরোজার মা এত সহজে ভোলার পাত্রী না, কাছে এসে লাল বানুর চোয়ালে হাত বুলিয়ে দেয় সে। আর পারেনা লাল বানু, কান্নায় ফেটে পড়ে।
“ দেখ দেহি, এমন চান্দের লাহান মাইয়াডারে কি কইরা মারছে ! গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পইড়া গেছে। সবই কপাল রে হতভাগী, তোর মত পুড়া কপাল আমি দেহি নাই। “
লাল বানু বিদায় জানিয়ে দ্রুত পা চালায়, রান্না ঠিকমতো সময়ে না হলে তার আবার মাথা ঠিক থাকবে না। লাল বানুর এই গ্রামে আসা চার বছর হল। বয়স পনের হতে না হতেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে তাকে। পাত্র রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি, এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায়! লাল বানুর বাবা সর্বস্ব বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি কি আর জানতেন যে আশা করে তিনি তার মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, প্রতি রাতে সে নেশা করে তার মেয়েকে রক্ত রঞ্জিত করবে। বিয়ের দু বছরের মাথায় লাল বানুর ফুটফুটে এক মেয়ে হল। মেয়ের নাম সে দিয়েছে জোছনা। তার স্বামীকে একবার জোছনার বাপ বলে ডাকাতে চুলের মুঠি ধরে বাইরে বের করে দিয়েছিল তার স্বামী।
“ একটা ছাওয়াল জন্ম দিবার মুরোদ নাই, আমারে ডাকে জোছনার বাপ! আর একবার কইয়া দেখিস, মুখে ঝামা ঘষে দিমু।“
লাল বানু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল, সামনের সব কিছু তার সামনে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে লাগল, কপোল বেয়ে নামলো অশ্রুধারা।
লাল বানু দ্রুত ঘরে ঢোকে। জোছনাকে একা ঘরে থুয়েই পুঁইশাক তুলতে গিয়েছিল সে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই ধক করে উঠল তার বুক, তার মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে! লাল বানু সে সংসারে আছে তাকে নরক ই বলা চলে। কিন্তু তার মধ্যেও এই মেয়েটাই তার বাঁচার একমাত্র সম্বল। জোছনার বয়স এই জষ্টি মাসে দুই হবে। মেয়েকে রেখে দ্রুত হেসেলে যায় লাল বানু। দুপুরে তার স্বামী মফিজ খেতে আসে। তরকারির স্যালন হাতে দাড়ায় থাকে লাল বানু। কাল রাতের অত্যাচারের পর থেকেই তার জ্বর এসেছে, তরকারি চেখে দেখেও কিছু বোঝেনি সে। ফলাফলও কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল। পুঁইশাকের তরকারী একগাল নিতেই প্লেটখানা ছুড়ে মারল সে লাল বানুর দিকে।
“ খা*কির পুত, একটা তরকারী রানতে গিয়ে তোর আধ মণ লবণ দেয়া লাগে। বের হ, বের হ এক্ষুনি।“
লাল বানু স্বামীর পা ধরে ক্রমাগত কাঁদছে আর মফিজ একটানা তাকে লাথি মারছে। লাথি মারতে মারতে মফিজ এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেল, লাল বানু ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে উঠানে পড়ে আছে। ঘরের ভিতর থেকে জোছনার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
“ চোপ!!!” প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে ওঠে মফিজ আলি। তার কথার ব্যাঙ্গ করতে যেন কান্নার আওয়াজ আর বেড়ে যায়। হনহন করে বাড়ির বাইরে চলে যায় মফিজ ।
কিছুক্ষণ পর উঠে বসে লাল বানু। দৌড়ে ঘরে গিয়ে জোছনাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে। পাশের বাড়ির ফিরোজার মা আবার আসে, সম্ভবত একটু আগে হুটোপুটির শব্দ তার কানে গিয়েছে।
“ ভর দুপুর হইয়া গেল, গোছল করছস? আমার লগে চ”
কোন কথা না বলে জোছনাকে ঘুম পাড়িয়ে ফিরোজার মা কে অনুসরণ করে লাল বানু। ঘাটে আজ তারা বোধহয় দেরিতে এসেছে, তারা দুজন ছাড়া ঘাটে আর কেউ নেই। পানিতে নামতেই আঁতকে ওঠে ফিরোজার মা।
“ আল্লা, আল্লা, দুধ আকায় দিয়া আইছি, তুই গোছল কর, আমি আইতাছি।“
দৌড়ে চলে যায় ফিরোজার মা। লাল বানু নিজের ক্ষত বিক্ষত দেহ অবগাহন করে নদীর জলে, রক্তের দাগ মুছে যায়, মনের দাগ মুছাবে কে। গোসল করে নদীর পাড়ে ভেজা শাড়ি পরেই হাঁটা দেয় লাল বানু। ঠিক তখনি আড়চোখে দেখতে পায় তার বেশ কয়েক কদম পিছনে কে আসছে, অচেনা পুরুষ মানুষ। এমনিতে একা দাড়িয়ে, তার উপর ভেজা শাড়ি গায়ের সাথে লেপটে আছে, লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে যায় লাল বানু। দ্রুত পা চালায় বাড়ির দিকে। আড়চোখে দেখে পিছনের লোকটাও তার সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত আসছে। বুকের ভিতর যেন ঘণ্টা বাজছে লাল বতির । এবার সে রীতিমতো দৌড়ানো শুরু করে। পিছনে তাকিয়ে দেখে লোকটাও দৌড়ানো শুরু করেছে। আতংকিত লাল বতি দৌড়াতে দৌড়াতে উঠানে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজার ফাক দিয়ে যা দেখে তাতে শিউরে ওঠে সে। সেই লোকটা উঠানে এসে এদিক ওদিক কি যেন খুজছে। তারাতারি শাড়ি পালতে নেয় সে। লোকজন কে ডাকতেও পারছে না, কারণ লোকজন ডাকাডাকি হলে তার স্বামী জানবেই, আর তার স্বামী এই কথা জানলে কি পরিণতি হবে টা জানে লাল বানু। লোকটা এখনো দাড়িয়ে আছে। ঘরের ভিতর থেকে দা টা হাতে নেয় লাল বানু। শাড়ির আঁচলের ভিতরে কোনোমতে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে সে। তাকে দেখেই লোকটা দ্রুত কাছে আসতে থেকে। আতংকে জমে গিয়ে লাল বতি দা খানা শক্ত করে এঁটে ধরে। কাছাকাছি এসেই লোকটা জিজ্ঞাস করে-
“ মফিজ মিয়া বাইত্তে আছে নী ?”
জমে যাওয়া লাল বানু কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
“ না, দুপ্পুরবেলা বাইর হইয়া গেছে। আফনার পরিচয়?
“ আমার নাম আনিস। মফিজের লগে আমিও কাম করি।“
“ অ, আচ্ছা। উনি বাড়িত নাই। পরে আইয়েন।“
“ এক গেলাস পানি দিবেন ভাবি, গলা ডা শুকায়ে কাঠ হয়া গেছে”
লাল বানু গ্লাসে পানি এনে দেয়। লোকটার পানি খাওয়া দেখেই বোঝা যায় মোটেও তৃষ্ণা পায়নি তার। লাল বানুর পুরনো ভয়টা ফিরে আসে। তার সাথে যোগ হয় বিরক্তি। লাল বানু এবার মাথা তুলে লোকটাকে দেখে। লম্বা, পেশীবহুল শরীর। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় লাল বানু। আনিস এই সুযোগটাই নেয়। দুনিয়ার গল্প শুরু করে , লাল বানু মুখে এবার বিরক্তি স্পষ্ট। তবু থামে না আনিস। এদিকে মফিজের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় মফিজ বাড়ি ফিরলে কি হবে তা ভাবতে গিয়ে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে তার। শেষে না পেরে বলে ওঠে-
“আনিস ভাই, আমার কাম আছে, আপনি অন্যদিন আয়েন। “
“ মফিজ ভাই আইব না?”
“ তার আহনের ঠিক আছে, আপনি আইজকা যান।“
“ আর এক গেলাস পানি দিবেন ভাবী?”
লাল বানু রেগে যায়, তবু না বলতে গিয়েও শেষে ঘরের মধ্যে থেকে পানি আনে। পানি আনিসের হাতে তুলে দেয়ার সময় পায়ের শব্দে পাশে তাকায়। যা দেখে তাতে হাতের গ্লাস হাত ফস্কে পড়ে যায়। মফিজ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টির ভাষা লাল বানু জানে। দ্রুত ঘরের মধ্যে চলে যায় সে। মফিজ এসে আনিসকে কিছু একটা বলে, তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আনিস চলেই যাচ্ছিল, সে থেমে যায় এক আর্তচিৎকারে। ঘরের মধ্যে থেকে অমানুষিক এক চিৎকার ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে। স্তব্ধ হয়ে যায় আনিস, সে জানে এ কার চিৎকার। একটানা অনেকক্ষণ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে, পা তার চলতে চায় না। সে জানে এর জন্য সে ই দায়ী।
( চলবে)

Comments

Popular posts from this blog