গল্পঃ টেলিপ্যাথিক নট ( Telepathic Knot)

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

শেষ পর্ব

ড রায়হান ইজিচেয়ারে বসে আছেন। মাঝে মাঝে চিন্তিত মনে তিনি ধূমপান করছেন। সিগারেট জিনিসটা তার মহাশত্রু। এই সিগারেটের কারণে তিনি তার সংসার হারিয়েছেন, স্পার্ম কাউন্ট কমে গিয়ে বাচ্চা নেবার ক্ষমতা হারিয়েছেন, স্ত্রীর সাথে এ কারণে ডিভোর্সও হয়ে গেছে কিন্তু তিনি সিগারেট ছাড়েননি। সিগারেটকে দেখে হটাত রায়হান সাহেবের মনে একটা চিন্তা আসলো, যখন তিনি বিষয়টাকে অনুধাবন করতে পারলেন, একেবারে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে ওঠার জোগাড় হল তার। বিষয়টাকে তিনি এভাবে কখনও ভেবে দেখেননি। রাশেদ এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, অনেকটা বিরক্ত হয়েই সে গলা খাঁকারি দিল। রায়হান সাহেব বাস্তবে ফিরে এলেন।
“আংকেল, হটাত জরুরি কিছু বলবেন বলে ডাকলেন যে।”
“ হ্যাঁ, শোন রাশেদ...” রায়হান সাহেবের বোঝানোর ধরণটা অনেকটা শিক্ষকদের মত, শিক্ষক যেন তার প্রিয় ছাত্রকে বোঝাচ্ছেন, “ আমাদের মস্তিষ্কে অনুভূতির ধরণটা এমন যে তুমি যখন কোন স্থানে ব্যাথা পাও তখন সেখানকার নিউরনগুলো তোমার মস্তিষ্ককে তা জানান দিয়ে সাম্যাবস্থা রক্ষা করে। কিন্তু প্রক্রিয়াটা উল্টোও হয়ে যেতে পারে।”
রাশেদ একটু অবাকই হল, বিষয়টাকে পুরোপুরি সে বোঝেনি।
“ মানে, প্রক্রিয়া উল্টো করতে ......”
“ মানে ধর তুমি কল্পনা করলে যে তুমি আঘাত পেয়েছ। সেই আঘাতের যন্ত্রণাও তুমি তোমার মস্তিষ্কে অনুভব করলে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তোমার শরীরের কোথাও আঘাত লাগেনি। কিন্তু সাম্যাবস্থা তো থাকতেই হবে। তাই, তোমার মস্তিস্ক তুমি যেখানে ব্যাথা অনুভব করেছ সেখানে একটা ক্ষত তৈরি করল, সাম্যাবস্থা টিকে থাকল। এমন তোমার ক্ষেত্রে হতে পারে। তুমি ব্যাথা কল্পনায় পেয়েছ, সাম্যাবস্থা রক্ষার্থে তোমার মস্তিস্ক দাগ তৈরি করছে। ”

রাশেদ অবাক হয়ে শুনছিল। ব্যাখ্যাটা তার কাছে বিশ্বাস যোগ্য মনে হলেও সে এটা মানতে পারছে না। কেন মানতে পারছে না তা সে জানে, তার পরের প্রশ্নই সব পরিস্কার করে দিল।
“ আংকেল, এমন কি হতে পারেনা যে নিলাঞ্জনা বলে সত্যিই একজন আছে?”
ড রায়হান রাশেদের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন। ছেলেটা তার কল্পনার প্রেমে পড়েছে, এর ফল যে মোটেও ভাল হবে না তা তিনি বুঝতে পারছেন।
“ রাশেদ, তুমি সায়েন্সের ছাত্র। তুমি বেশ ভালভাবে জানো যে আমাদের কল্পনার ভিত্তি আমাদের বাস্তব। নিলাঞ্জনা মেয়েটার কল্পনা তোমার বাস্তবে দেখা কোন মেয়ের প্রতিচ্ছবি। তাছাড়া কোনভাবেই সায়েন্স এটা সমর্থন করে না।”
“ কিন্তু আংকেল , জানেন তো, শেক্সপেয়ার বলেছেন, দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ।”
ড রায়হান হতাশ, মহা হতাশ, এ লাইন ছেলেরা তখনই বলে যখন তারা প্রেমে পড়ে। রাশেদ প্রেমে পড়েছে, শুধু পার্থক্যটা হল সে বাস্তব জগতের কার প্রেমে পড়েনি, প্রেমে পড়েছে ব্যাখাতিত জগতের কোন রূপসীর উপর।

রাশেদ রিক্সায় করে বাড়ি ফিরছে, গাড়িটা ইচ্ছা করেই সাথে আনেনি সে। সিএনজি তে করেও যেতে পারত, কিন্তু তার কোন তাড়া নেই আজ। রাশেদের মন জুড়ে কেবল একটা নামই ঘুরছে , নিলা, নিলাঞ্জনা......
রিক্সা যে চালাচ্ছে তিনি প্রবীণ মানুষ। মাঝে মাঝেই তাকে বাংলা সিনেমার কিছু গান গাইতে শোনা যাচ্ছে। রাশেদ একটু কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বুড়ো বুঝতে পারল না। টি এস সির কাছাকাছি আসতেই রাশেদ আনমনে দাড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখল। হটাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো থমকে গেল সে, হ্যাঁ, এটা নিলা। এতোটাই অবাক হল রাশেদ যে রিকশাওয়ালাকে যে থামতে বলবে সে কথাও ভুলে গেল। মেয়েটাকে ছাড়িয়ে কিছুদূর আসার পর হটাৎ তার হুশ হল। এক দৌড়ে সে মেয়েটা যেখানে ছিল সেখানে এলো, মেয়েটা নেই, নিলাঞ্জনা নেই, ক্ষণিকের অতিথির মতো সে চলে গেছে । হতাশায় গুমরে উঠল রাশেদ,আশেপাশের মানুষ খুব অবাক হয়ে দেখল এক যুবক রাস্তার ধুলোয় লুটিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
নিলার মেজাজ আজ বেশ চড়ে গেছে। আধাঘণ্টার কথা বলে কেউ দুই ঘণ্টা দেরি করতে পারে তা তার জানা ছিল না। একটানা সে সমানে লিপিকে ঝাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। লিপিও মাঝে মাঝে সরি দোস্ত, মাফ করে দে দোস্ত বলে আমতা আমতা করছে। নিলার আজ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। ড রায়হান নিলার মামা হন, তার কাছেই আজ যাবার কথা ছিল। লিপির দেরি হবার কারণেই এত ঝামেলা হল।
“ তোর কি আক্কেল বলে কোন কিছু নেই রে। ১০ টায় আসার কথা বলেছিলি, দেখ তো কটা বাজে!! দেখ!!”
“ ইয়ে মানে, সরি দোস্ত। আসলে একটা কাজ ছিল বুঝলি...”
“ তুই ফয়সালের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি, তাই না?” নিলার মুখে এ কথা শুনে অনেকটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে লিপি, নিলা মেয়েটা কেমন করে জানি সব টের পেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে লিপি।
“ হ্যাঁ তাও ভাল যে ফয়সালকে ছোঁয়া যায়। তোর প্রেমকুমারকে তো ধরা ছোঁয়াও যায় না, উনি স্বপ্নের মধ্যেই ইয়েস বউ, হাজির আছি বলে হাজিরা দিয়ে শুধু শুধু চড় খেয়ে বিদায় নেন।”
নিলা আহত চোখে লিপির দিকে তাকায়, লিপি নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটু অনুতপ্ত হয়। সর্বদা হাসিখুশি এই মেয়েটার জীবনে স্বপ্নটা একটা কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“ স্যার, আমি একটা স্বপ্ন দেখি।”
“ হ্যাঁ, বল নিলা মামনি...” রায়হান সাহেব নিলাকে সহজ করার চেষ্টা করলেন।
“ জি মানে, কিভাবে যে বলি, স্বপ্নটা...আসলে...”
“ একটা ছেলের সাথে, তাইতো?” রায়হান সাহেবের কথায় লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে নিলা।
“ নিলা, এই বয়সে এটা অতি স্বাভাবিক। তুমি লজ্জা করো না, বল।”
“ নদীর পাড়ে একটা ছেলে, আমার...আমার হাত ধরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কথা হয়, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে সেগুলোর অধিকাংশ মনে থাকে না। কিন্তু স্বপ্নের শেষে...” রায়হান সাহেব নড়েচড়ে বসেছেন, তার কুঁচকে যাওয়া ভ্রু অস্থিরতার জানান দিচ্ছে “ শেষে?”
“ শেষে আমি দেখতে পাই সেখানে ছেলেটা বসে নেই, ভয়ংকর দানব আকৃতির একটা প্রাণী বসে আছে। আমি ভয়ে, আতঙ্কে ওই প্রাণীর গায়ে মারতে যাই আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে আমার ডান হাত লাল হয়ে ব্যাথায় টনটন করে।”
রায়হান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু সেই উত্তেজনা তিনি কাউকে বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না। তার মনে বারবার একটা প্রশ্নই রেখাপাত করছে, একই করে সম্ভব! ঠিক সেই মুহূর্তে রায়হান সাহেবের চেম্বারের দরজা প্রচণ্ড জোরে দড়াম করে খুলে গেল, সেখানে রাশেদ উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে দেখা গেল, “ আংকেল! আমি নিলাকে দেখেছি।”

রাশেদ নিলার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মজার ব্যাপার হল রাশেদ স্বপ্নটা আর দেখছে না। সেদিন চেম্বারে নিলাকে দেখার পর রাশেদ হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিল। একই অবস্থা হয়েছিল নীলারও। রাশেদ আর নিলা একদৃষ্টিতে একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, কিছুক্ষণ পর ধপ করে একটা শব্দে সবার ঘোর ভাঙলে দেখা গেলো নিলা অজ্ঞান হয়ে গেছে। রাশেদ নিলার বিয়ের খবরে ইমতিয়াজ নবি তো খুশি হতে পারেনই নি, আফিয়া বানুও নাখোশ। আফিয়া বানুর ধারণা তার ছেলেকে এই মেয়ে যাদু করেছিল, না হলে অপরিচিত এই মেয়েকে রাশেদ স্বপ্ন দেখবে কেন? তাকে মাঝে মাঝেই হতাশাগ্রস্থের মতো মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ইমতিয়াজ নবি বিমর্ষ মনে বসে আছেন। তার ব্যবসায়িক পার্টনার আমজাদ রহমানের একমাত্র মেয়ের সাথে তিনি রাশেদের বিয়ে ঠিক করেছিলেন, বিয়েটা হলে আমজাদ শেখের অংশটুকু তিনি পেতেন। সেই সম্পদের অপ্রাপ্তিই তার বিমর্ষতার কারণ।মাঝে মাঝে তাকে ‘শুয়োর আমজাদ’ বলে বিড়বিড় করতে শোনা যাচ্ছে।আফিয়া বানু বিয়ের ব্যাপারে অমত করেছিলেন বটে কিন্তু রাশেদ একগুঁয়ে হয়ে আছে, বিয়ে করতে হলে সে নিলাকেই করবে। নিলার মা বাবা নেই, মামার কাছেই মানুষ হয়েছে। রাশেদের একগুঁয়েমিতেই শেষ পর্যন্ত আফিয়া বানু বিয়ের পয়গম নিয়ে গেলেন, যদিও বেয়াই বাড়ি সবসময় তাকে নাক সিটকে থাকতে দেখা গেছে।

ড রায়হানকে অন্য একটা চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনি ভাবছেন, এটা কি কোন টেলিপ্যাথিক সম্পর্ক ছিল নাকি রাশেদের সাজানো নাটক? মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা অনাথ মেয়েকে তার বাবা মা মেনে নেবে না তা সে হয়ত জানত, সেই জন্যই কি এই নাটক? একই ডাক্তারের কাছে আসা, একই সময়ে উপস্থিত হওয়া কি খুব বেশি নাটকীয় নয়? কিন্তু দাগটা, দাগটা কিভাবে আসলো? রায়হান সাহেব ভাবছেন, যদিও তিনি জানেন এই ভাবনার কোন ফলাফল নেই।

রাশেদ নিলাকে নিয়ে সেদিন খেতে গিয়েছিল। রেস্তোরায় বসেই প্রথমে রাশেদ যে প্রশ্নটা নিলার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল তা হল, “ তুমি আমাকে চড় মারো কেন?”
রাশেদের প্রশ্ন শুনে পুরোপুরি ঘাবড়ে গেল নিলা। প্রথম থেকেই সে বেশ লজ্জা পাচ্ছে, স্বপ্নের একজন তার সামনে জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে দাঁড়াবে এটা সে কখনো ভাবতে পারেনি।
“ মানে...আসলে আমি মারতে চাইনি। আপনাকে আমি...”
রাশেদ হটাত নিলার হাত ধরে ফেলে, হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিলার দিকে তাকিয়ে বলে, “ কথা দাও, কোনোদিন দূরে যাবে না,কাছে থেকে যত চড় মারতে হয় মেরো।”
রাশেদের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল নিলা, অন্যদিকে রাশেদ নিলার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মেয়েটা হাসলে যে তাকে এত সুন্দর দেখায় তা সে ভাবতে পারেনি।
রেস্তোরা থেকে রাশেদ নিলাকে নিয়ে বের হয়ে আসলো। তাদের সম্পর্ক কতটা সহজ হয়েছে তা তাদের যুগলবন্দী হাতই বলে দিচ্ছে।
“ আইসক্রিম খাবো...” রাস্তার বিপরীত দিকে একটা আইসক্রিম স্টলের দিকে আঙুল দেখিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো বায়না করে নিলা। রাশেদ হেসে বলে, “ আচ্ছা রাজকন্যা, তুমি দাড়াও আমি আসছি।”
আইসক্রিম কিনে নিলার দিকে ফেরামাত্রই রাশেদ দেখতে পায় একটা ট্রাক অফরোডে গিয়ে নিলার দিকে ছুটে যাচ্ছে। রাশেদ নিলার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা আর্ত চিৎকারই দিতে পেরেছিল, কিন্তু ততক্ষনে......সব শেষ।

রাশেদকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। সে মাথার চুল ছিঁড়ছে, হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই দেয়ালে ছুড়ে মারছে আর শুধু নিলা, নিলা বলে গগনবিদারী চিৎকার করছে। পাশের এক ডাক্তারকে ডেকে আনা হল, তিনি নার্ভ শান্ত করার জন্য রাশেদকে ঘুমের ওষুধ দিলেন। রাশেদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
নিলা আজ খুব সেজেছে। চোখে যত্ন করে কাজল দেয়া, হাতে কাচের চুড়ি, হলুদ শাড়ি। নিলার রুপে নদীর পাড়ের জোছনাও যেন আজ নিলাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। ভরা জোছনায় শান্ত নদীর পাড়ে যুবক যুবতীর নিস্তব্ধতা, এ যেন অপার্থিব জগতে এক পার্থিবতার স্পর্শ।

রাশেদ ঘুম থেকে উঠছেনা, গত ২৭ ঘণ্টা সে ঘুমিয়ে। আফিয়া বানু ছেলের পাশে বসে আছেন পুরোটা সময়, মাত্র কদিনে ছেলের এই বিপর্যয় তিনি মেনে নিতে পারছেন না। ৩০ ঘণ্টা পার হবার পরও যখন রাশেদের জ্ঞান আসলো না তখন আফিয়া বানুর মন কু ডেকে উঠল , তিনি হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারকে খবর দিলেন। ডাক্তার হুমায়ুন কবির রাশেদের পালস চেক করে চমকে উঠলেন,রাশেদ মারা গেছে অনেক্ষন আগে, মৃত্যুর কারণ, ইন্টারনাল ব্রেন হেমারেজ।

ড রায়হানের হাতে কড়া ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে বসে আছেন, ডিরঙ্কস করার এই বদভ্যাসটা তিনি বিদেশে গিয়ে করেছেন। মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আজকের মতো দিনে তো একটু আধটু করাই যায়। নিজের এত বছরের গবেষণার পরীক্ষালব্ধ ফলাফল তিনি আজ হাতে পেয়েছেন। দীর্ঘ ৭ বছর যাবত তিনি এ গবেষণা করছেন। প্রথম যখন তিনি এ সম্ভাবনার কথা তুলেছিলেন, খোদ তার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পর্যন্ত হেসে উঠেছিলো, যেন তিনি পাগলের প্রলাপ বকছেন। আজ হাতে কলমে তিনি তা প্রমাণ করলেন। তার পাশে মোটা একটা ফাইলে বড় বড় অক্ষরে লেখা-
                                                     Telepathik Knot
                                            Experiment one- Successful

আদিম কালে মানুষের ভিতরে এক প্রকার হরমন নিঃসৃত হত। হরমোন উৎপাদনকারী এ গ্রন্থিটির অবস্থান মানুষের মস্তিষ্কে। এ হরমোনের প্রভাবে আদিম মানুষ তাদের ভাষার অভাব বোধ করত না, এর মাধ্যমেই তারা টেলিপ্যাথিক উপায়ে যোগাযোগ করত, ঠিক যেমন মূক প্রাণীরা করে। সময়ের ব্যবধানে ভাষা আবিষ্কৃত হল, এ মাধ্যমের গুরুত্ব কমতে থাকল। একসময় মানুষের নিস্ক্রিয় অঙ্গাণুতে পরিণত হল এটি। প্রাচীনকালে যেমন কাচা মাংস আর গাছের বাকল হজম করার জন্য অ্যাপেন্ডিক্স থেকে উৎসেচক নিঃসৃত হত, কিন্তু কালের গর্ভে তা এখন নিস্ক্রিয় অংশ, ঠিক তেমনি এটি মানব মস্তিষ্কে এখনো আছে, নিস্ক্রিয় অঙ্গাণু হিসেবে।ড রায়হান প্রথমে এমন একটি উদ্দীপক তৈরি করলেন যা নিস্ক্রিয় অঙ্গাণুকে সক্রিয় করে তুলবে।উৎসেচক তৈরি নিয়ে রাত দিন অমানুষের মতো পরিশ্রম করেছেন ড রায়হান,৫ বছর গবেষণার পর টা আবিস্কারে সমর্থও হলেন। তবে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলেন তিনি, মানসিক সংযোগটা এতোটাই দৃঢ় হয়ে পড়ে যে সংযোগের এক অংশ ধ্বংস হয়ে গেলে অন্য অংশ টিকে থাকতে পারে না। সে কারণেই আদিম মানুষের একজন মারা পড়লে অন্যজনও কয়েকদিনে মারা যেত। কিন্তু এই সংযোগ বিচ্ছিন্নে দুই বাহকের মৃত্যু কাগজে-কলমেই তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন কিন্তু এটাকে একমাত্র বাস্তবে প্রমাণ করেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব। এই অংশটি নিয়েই রায়হান সাহেবের গবেষণা। এবার তার দরকার ছিল গবেষণার গিনিপিক।শুধু গিনিপিক নিলে হবে না, এমন দুটো গিনিপিক নিতে হবে যাদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি সম্ভব। রায়হান সাহেব বেছে নিলেন রাশেদকে। রাশেদের জন্য তার খারাপ লাগলেও ইমতিয়াজের কথা ভেবে তার প্রতিহিংসা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এই ইমতিয়াজের কারণেই তার সংসার ভেঙেছিল। লিপির জন্মদিনে নিলাকে তার চোখে পড়ে, চোখে পড়ার মতই মেয়ে সে। অনেক দিনের প্লান মোতাবেক একটা নির্দিষ্ট দিনে তাদের দুজনকে অজ্ঞান করে তাদেরকে এক জায়গায় রেখে তাদের উপর উদ্দীপক প্রয়োগ করেন রায়হান।তাদের মধ্যে KNOT তৈরি হবার সময় কেবল তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাদের উপর বিশেষ ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছিলো রেক্টিফাইড অ্যামনেশিয়া সৃষ্টির জন্য, যাতে ওই দিনের কোন ঘটনা তাদের মনে না থাকে। ফলাফল পেলেন মাত্র কয়েকদিন পরেই। কিন্তু তার মুল কাজ করা বাকি ছিল। তিনি দেখতে চাইছিলেন বন্ধনের এক অংশ যদি ধ্বংস হয়, অন্য অংশ কি টিকে থাকবে? তাই ট্রাক ভাড়া করে চাপা দিয়ে নিলাকে মারলেন এবং ফলাফল পেলেন আজ রাশেদের মৃত্যুতে। রায়হান সাহেবের বড্ড ক্লান্ত লাগছে, তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।

রাশেদ আর নিলা একে অপরের হাত ধরে নদীর পাড়ে বসে আছে। রাশেদ মাঝে মাঝে শিষ দেবার চেষ্টা করছে কিন্তু নিলার ভ্রুকুটিতে আবার বন্ধ করে দিচ্ছে। তার পাশেই রায়হান সাহেব বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে আছেন। তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি এখানে কেন! তার তো এখানে থাকার কথা না। রায়হান সাহেবের সব মনে পড়ছে, তিনি হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছেন। প্রথম যখন তিনি উদ্দীপক আবিষ্কার করেন তখন নিজের উপরেই তা প্রয়োগ করেছিলেন। অন্য কারো মধ্যে এই উদ্দিপক ছিল না তাই কোন বন্ধন তৈরি হয়নি। কিন্তু যখন রাশেদ নিলার টেলিপ্যাথিক নট তৈরি হচ্ছিলো তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার মানে, নটটা Duel Knot না হয়ে Triangular Knot হয়ে গেছে! অর্থাৎ, রাশেদ-নিলার টেলিপ্যাথিক নটের তিনিও একটা অংশ ছিলেন! যেহেতু সংযোগের ২ টা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, ৩য় অংশ টিকে থাকার কোন উপায় নেই!স্বপ্নের মধ্যেই রায়হান সাহেবের মনে হল তিনি ঘামছেন, তার প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেতে লাগল। ঠিক সে সময় রাশেদ আর নিলা দুজনেই খুব সুন্দরভাবে রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু রায়হান সাহেবের কাছে সে হাসি বড্ড তেঁতো ঠেকল। তিনি খুব জোরে একটা আর্ত চিৎকার দিলেন। সে আর্ত চিৎকার বাস্তব জগতের কেউ না শুনলেও স্বপ্নজগতের মানুষেরা এর সাক্ষী হয়ে থাকবে চিরকাল।
(সমাপ্ত)
                                                    

Comments

Popular posts from this blog