গল্পঃ ডার্ক ম্যাজিকঃ দ্যা রিটার্ন অফ দ্যা প্রিস্ট

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

শেষ পর্ব


গলির শেষ প্রান্তে নারীমূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে, একবারে স্থির হয়ে। বিপরীত দিক থেকে ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো আসায় ছায়ামূর্তির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। মোতালেব কিছুক্ষণের জন্য চোখ সরু করে দাঁড়িয়ে রইল, মাতাল হলেও এটুকু সে বুঝতে পারছে যে মাঝরাতে এ রাস্তায় কোন নারী দাঁড়িয়ে থাকা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে সামনে এগিয়ে গেলো মোতালেব। ঘটনাগুলো দ্রুত চোখের সামনে দ্রুত ঘটে গেলো। নারীমূর্তি ছুটে এসে মোতালেবকে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলল, ধাক্কার তোপ সামলে ওঠার আগেই নারীমূর্তি মোতালেবের বুকের উপর চেপে বসল। মৃত্যুর আগে মোতালেব শুধু দেখতে পেরেছিল অনিন্দ্যসুন্দর একখানা মুখ, যাতে ভর করেছে বন্য হিংস্রতা। গলির মধ্যে প্রবাহিত বাতাস মোতালেবের বুকের বাম পাশের ফুটো দিয়ে ঢুকে অদ্ভুত শব্দ করছিল, সে শব্দ অনেকে শুনতে পারলেও শব্দের উৎস সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিল না।

মফিজুল করিম টেলিভিশনের সামনে বসে আছেন, নিশ্চল হয়ে। বুড়ো বয়সে তার একটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা, দ্রুত সময় কেটে যাওয়ার এর চেয়ে ভাল মাধ্যম আর হতে পারেনা। তখন হটাত খবরটা আসলো, খবরটা দেখেই মফিজুল করিম নড়েচড়ে বসলেন। তার বাড়ির কিছুটা পাশেই খুন হয়েছে আর সে খবরটা তিনি টেলিভিশনে পাচ্ছেন! সংবাদ পাঠিকার পরের কথাগুলো শুনে মফিজুল করিমের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। মফিজুল করিম টেলিভিশন বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, শেফা মিথ্যা বলেছে, সে বইটা পড়েছে। দ্যা সোল হ্যাজ রিটার্নড।
২৬ ফেব্রুয়ারী,১৯৯২। মফিজুল করিম অফিসের চেয়ারটাতে বসে অস্থিরভাবে দোল খাচ্ছেন। তার টেবিলের উপর একটা পার্সেল রাখা। মফিজুল করিমের চোখ পার্সেলের উপর নিবদ্ধ, তিনি বারবার চেষ্টা করছেন চোখ সরিয়ে নিতে, পারছেন না। পার্সেলটা অফিসের আর্কাইভে রাখা যাবেনা, কারণ পার্সেলটা ব্যাক্তিগত। পার্সেলের সাথে আসা গোলাপি রঙের কাগজের চিঠিটা হাতে নিলেন তিনি, চিঠির প্রেরক জগবন্ধু সিং। চিঠির ভাষাটা অদ্ভুত বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা অবাক হননি মফিজুল করিম, বরং এমন না হলেই অবাক হতেন। পার্সেলটাতে একটা বই আছে, যে বইয়ের পিছনে গত ৫ বছর লেগে ছিলেন তিনি। চিঠির দিকে আবার নজর দিলেন তিনি, জগবন্ধু চিঠির নিচে স্পষ্টভাবে লিখেছে এই বই ৭ জনের প্রাণ নিয়েছে, শুধুমাত্র বন্ধু বলেই মফিজুল করিমের অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। প্যাকেটটা ব্রিফকেসে ভরে নিলেন মফিজুল করিম,অসময়ে তার অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া পাশের কেবিনের সাইদুর সাহেবের ভ্রূকুটির সৃষ্টি করলেও তাতে খুব একটা পাত্তা দিলেন না মফিজুল করিম।

লাইলা জানালার পাশে বসে আছে, দুপুর থেকেই আজ তার মন খারাপ। তার বাবা আজ অসময়ে অফিস থেকে ফিরেছে, সে বাবাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেও বাবা অন্য কথা বলে এড়িয়ে গেছে। এর আগে মফিজুল করিম এমন করেননি। পুরনো কোন জিনিস আনলেও আগে মেয়েকে দেখাতেন, তারপর স্টাডিতে নিয়ে রাখতেন। লাইলা স্পষ্ট দেখেছে তার বাবা ব্রিফকেস নিয়ে স্টাডি রুমের দিকে গিয়েছে, যার মানে কিছু একটা তিনি এনেছেন, কি এমন এনেছেন যে তাকে দেখানো যাবে না! লাইলা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, স্টোররুম থেকে স্টাডিরুমের এক্সট্রা চাবি এনে রেখেছে, মফিজুল করিম বাইরে গেলেই স্টাডিতে ঢুকবে সে।

টেলিফোনটা মফিজুল করিমের দিকে বাড়িয়ে দিলেন আরজু সাহেব,”তোর ফোন এসেছে, ভাবি ফোন দিয়েছে।“
টেলিফোনটা হাতে নিয়ে অবাক ই হলেন মফিজুল করিম, ওপাশ থেকে সামান্য ফোঁপানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মফিজুল করিম কিছুক্ষণ হ্যালো বলার পর সায়মা করিমের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো,
“ তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসো, লাইলার জ্বর এসেছে। দুপুরেও তো বেশ ছিল, হটাত এত জ্বর আসলো কেন! তুমি যাওয়ার কিছুক্ষন পরই জ্বর এসেছে।“সাইমা করিমের কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো, তারপর পরই ক্রেডলে সশব্দে টেলিফোন আছড়ে পড়ল। মফিজুল করিম বন্ধুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন, তার মুখের উদ্বিগ্নতা যদিও আরজু সাহেবের চোখ এড়াল না তবুও তিনি এ নিয়ে প্রশ্ন করলেন না।

রাত নয়টার সময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন মফিজুল করিম, পথের মধ্যে গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়ে ফিরতে দেরি হল। বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে অনেকবার সাইমার নাম ধরে ডাকলেও সাইমা করিম সাড়া দিলেন না। বাধ্য হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন মফিজুল করিম। ভিতরে ঢুকে অবাক হলেন তিনি, এই রাতেও পুরো বাড়ি অন্ধকার, সাইমা কি তবে লাইলাকে নিয়ে ডাক্তারর কাছে গিয়েছে? কিছুটা সামনে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠলেন তিনি, স্টাডিরুমটা হাট করে খোলা, চাবিটা দরজায় ঝুলছে।দেখেই বুঝতে পারলেন লাইলার কাজ, মেয়েটা প্রচণ্ড একগুয়ে।নিশ্চিত বইটা পড়ার জন্য...বইয়ের কথা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলেন মফিজুল করিম, এক দৌড়ে স্টাডিরুমের ভিতরে ঢুকলেন, তার আতংক সত্য প্রমাণিত হল যখন দেখলেন বইটা টেবিলের উপর খুলে রাখা, লাইলা বইটা পড়েছে। বইটা হাতে নিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে মফিজুল করিম দাঁড়িয়ে আছেন আর তখনই চিৎকারটা শোনা গেলো, একটা তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার। মফিজুল করিম বইটা হাতে নিয়েই দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন, দরজাটা খোলা। মফিজুল করিম দ্রুত ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সাইমা করিম খোলা চোখে মফিজুল করিমের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। সারা ঘরের মেঝেতে কালচে রঙের তরল ছড়ানো, জোছনার আলোতেও মফিজুল করিম বুঝতে পারছেন সে তরলের উষ্ণতাই প্রমাণ করে সেটা রক্ত। ঠিক তার পাশে বসে আছে লাইলা, তার চোখেমুখে পৈশাচিক হাসি। মফিজুল করিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে লাইলার হাসি দেখছেন, লাইলা এমন নিষ্ঠুরভাবে হাসে না, এটা লাইলার হাসি নয়। লাইলা উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে দৌড়ে গেলো, তখনই মফিজুল করিমের সামান্য হুশ হল। জীবনের এ পর্যায়ে এসে দীর্ঘদিন পর তিনি ডুকরে কেঁদে উঠে মেয়ের পিছু নিয়ে ছাদের দিকে দৌড়ে গেলেন। লাইলা ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, পা আরেকটু সামনে দিলেই সামনের পিচঢালা পথে পড়ে যাবে। মফিজুল করিম খুব ধীরে ধীরে লাইলার দিকে আগাচ্ছে, মেয়েটা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মফিজুল করিম মৃদু চাপা হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তিনি লাইলার দিকে দৌড়ে গেলেন আর তখনই লাইলা সামনের দিকে পা বাড়াল। মুহূর্তটা এখনো মনে আছে মফিজুল করিমের, লাইলা পড়ে যাচ্ছে,হাতদুটো বাড়িয়ে দিয়ে কিছু ধরতে চাচ্ছে সে,লাইলার দু চোখে আছে আতংক, নিখাদ আতংক। লাইলার লাশটা পরে যখন মফিজুল করিম দেখেছিলেন তখনও লাইলার চোখদুটো খোলা ছিল, সে চোখে ওই একটা অনুভুতিই ছিল, আতংক। আজ এত বছর পরেও মেয়ের চোখের সে চাহনি তিনি ভুলতে পারেননি। এত বছর পর সামনে বসে থাকা শেফার চোখেও তিনি সেই আতংকই দেখতে পারছেন।

মফিজুল করিম শেফার বাড়ির উদ্দেশ্যেই রউনা দিচ্ছিলেন, তখনই মেয়েটা এসে হাজির। মেয়েটাকে এনে সোফায় বসিয়েছেন মফিজুল করিম, অবাক হয়ে আজ তিনি হটাৎ লক্ষ্য করছেন শেফা দেখতে অনেকটা লাইলারই মতন। শেফা কাঁপছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার জ্বর এসেছে, এই গরমেও তার গায়ে একটা চাদর।
“ তুমি বইটা পরেছিলে, তাই না শেফা?” বৃদ্ধের কথা শুনে শেফা মুখ নিচু করে রইল, পরক্ষনে কেঁদে ফেলল।
“ আমি কাল রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন...”শেফা বেশ আগ্রহের সাথে বলতে শুরু করলেও বৃদ্ধের একটা কথাই তাকে থামিয়ে দিলো,
“ ওটা স্বপ্ন ছিল না শেফা।“ বৃদ্ধের কথা শুনে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইল শেফা, বৃদ্ধের কথার অর্থ সে বুঝেও বুঝতে পারছে না।
“ শেফা, এই বইয়ের কারণে আমি আমার জীবনের সবটুকু হারিয়েছি। আমার সহধর্মিণী, আমার মেয়ে, আমার সবকিছু।“ খুব দৃঢ় ভাবে কথা গুলো বলতে চেষ্টা করলেও মফিজুল করিমের কণ্ঠ আবেগে কিছুটা কেঁপে উঠলো ।
“ সবকিছু হারানোর পরে আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল একটাই, এই বইটাকে ধ্বংস করা। এতগুলো বছর সেই চেষ্টাই করে গিয়েছি। অথচ তোমার একটা সামান্য ভুলের কারণে আজ সেটা সম্ভব হল না।“
শেফা বৃদ্ধের কথা গুলো বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধি শেফার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন, তিনি ফের বলা শুরু করলেন,
“ বইটা সুচতুর ব্লাক ম্যাজিক দিয়ে তৈরি করা। ব্লাক ম্যাজিকের এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সিউডরস ম্যাস্কুলাম’। মানে হচ্ছে, তুমি বইটা পড়া মাত্র তোমার মধ্যে মৃত আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটবে, সেই আত্মা শুধুমাত্র অন্ধকারেই তোমার উপর পূর্ণ দখল পাবে। কাল রাতে তুমি যেটা দেখেছ সেটা সপ্ন ছিল না, সত্যি ছিল।“ বৃদ্ধের কথা শুনে শেফার মনে হল তার চারদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, সে সোফার পাশটা ধরে নিজের পতন ঠেকাল। শেফাকে এমন অবস্থায় দেখে মফিজুল করিম উঠে এসে শেফাকে ধরলেন। শেফা বিড়বিড় করে করে কিছু একটা বলছে, মফিজুল করিম দেরি করলেন না, আরজুকে ফোন করলেন, সময়ের অপচয়ের কারণে তিনি একবার সবকিছু হারিয়েছেন, আর কিছু হারাতে চাননা।
অনেক দিন পর মফিজুল করিম ড্রাইভ করছেন, একটু অসুবিধা হচ্ছে বটে। গাড়িটা ঠিক আছে দেখে বেশ অবাক হয়েছেন তিনি, প্রায় বছর গড়িয়ে গেলো গাড়িটার কোন যত্ন নেয়া হয়নি। শেফা পাশের সিটে বসে আছে, বসে না বলে শুয়ে আছে বললেই বরং ভাল হয়। মাঝে দু একবার অবশ্য সামান্য জ্ঞান ফিরেছিল, কিন্তু তারপর আবার বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মফিজুল করিম ঘড়িটা আরেকবার দেখে নিলেন, বিকেল গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে তার আর কিছু করার থাকবে না, সম্ভবত পরবর্তী শিকার হবেন তিনিই। আরজু সাহেবের বাড়ি এখনো অনেকটা দূরে, সেখানে পৌছাতে এখনো এক ঘণ্টা সময় লাগার কথা। মফিজুল করিম যখন আরজু সাহেবের বাড়ি পৌঁছালেন তখন মাগরিবের আজান দেয়া শুরু করেছে। আরজু সাহেব দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুললেন, তারপর ঘুমন্ত শেফার দিকে তাকিয়ে মফিজুল করিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” আজই শেষ দিন করিম।“

একটা ঘন অন্ধকার বন, তার ঠিক মাঝখানে শেফা বসে আছে। শেফা চোখ পিটপিট করে চারদিক দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু চারদিকে নিষক গাঢ় অন্ধকার। শেফা এবার প্রাণপণে চোখ মেলে সামান্য আলোর আশা করল, তবুও সামান্য আলো দেখা গেলো না। হটাত একটা ফিসফিসে শব্দে সচকিত হল শেফা, শীতল একটা অনুভূতি তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসছে। ফিসফিসে শব্দটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে, শেফা প্রাণপণে চেষ্টা করছে পিছন দিকে তাকাতে, পারছে না।শব্দটা শেফার ঘাড়ের কাছে এসে থামল, একটা শীতল নিঃশ্বাস শেফার ঘাড়ে পড়তেই ঘাড় ঘুরাল সে।অন্ধকারের মাঝে আরেক জোড়া অন্ধকার তাকিয়ে আছে শেফার দিকে, সেটা দ্রুত ছুটে আসলো তার দিক, সামান্যতম শব্দ করার সুযোগও পেল না সে।

মফিজুল করিম গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা বই নিয়ে বসে আছেন। নিজের পরের কাজের ধাপগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছেন। বইটা রেখে সাথে আনা বিশাল সাইজের ব্যাগটা খুললেন তিনি, ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাচের জার বেরিয়ে এলো। জারের ভিতরে ফরমালিনে ডুবানো জিনিসগুলো দেখে মফিজুল করিমের গা গুলাতে লাগল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই বিদঘুটে জিনিসগুলো তিনিই সংগ্রহ করেছেন। জারগুলো পরপর লেবেল দেখে সাজালেন তিনি, ভিতরে ফরমালিনে ডুবানো নানা বয়সের মৃত মানুষের হৃদপিণ্ড। এগুলো সংগ্রহের জন্যই রাত বিরেতে তাকে বের হতে হয়েছে। এসব কাজ কাউকে দিয়ে করানো যায় না, নিজেই করা ছাড়া উপায় নেই। নতুন এলাকায় বদলি করেছিলেন এই কাজের জন্যই, এলাকার গোরস্থানটা ছিল তার মূল লক্ষ্য। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল, শেফা মেয়েটার সামান্য কৌতূহল সব কিছু ভণ্ডুল করে দিলো। মফিজুল করিম বইটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তার চেয়ে মেয়েটার প্রাণের মুল্য অনেক বেশি, যে কাজটা তিনি করতে যাচ্ছেন সেটা শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক হবে কিনা তিনি জানেন না। ঠিক সে সময় উপরের তলায় প্রচণ্ড শব্দে কোন কিছুর পতন হল। মফিজুল করিমের বুঝতে বাকি থাকল না উপরে কি হতে পারে, তিনি দৌড়ে উপরের তলার দিকে গেলেন।

আরজু সাহেব নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না, তার চোখের সামনে লাল পর্দার মতো সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। তিনি ভাবতেও পারেননি যে শেফা নামের মেয়েটা হটাত করে জ্ঞান ফিরে পেয়ে হাতের বাঁধন ছিঁড়ে তার গলা এভাবে চেপে ধরবে। মফিজুল করিমের সাথে তিনি ভাল করে মেয়েটাকে বেঁধেছিলেন, কিন্তু মেয়েটার গায়ে হটাত করে এমন অমানুষিক শক্তি আসবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। এমন ঘটনার সম্মুখীন তিনি আগেও হয়েছেন, তবে এতটা বেকায়দায় তাকে আগে পড়তে হয়নি। আরজু সাহেব হাঁ করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকলেন, শেফার হাত আরও জোরে এঁটে বসেছে তার গলায়। ঠিক সে সময় একটা পোড়া গন্ধ পেলেন তিনি, হটাত করে শেফার হাতের বাঁধন ঢিল হয়ে গেলো। আরজু সাহেব মেঝেতে বসে পড়লেন, আর একটু হলেই তিনি মারা যেতেন।

মফিজুল করিম ঠাই দাঁড়িয়ে আছেন, তার এক হাতে কালো রঙের একটা মোমবাতি, সেটা নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। তিনি আরেক হাতের বই থেকে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ছেন, শেফা মেঝেতে বসে স্থির ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে । আরজু সাহেব তখনও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, বন্ধুর বিড়বিড়ানি তার কানে যাচ্ছে না। মফিজুল করিম ততক্ষণে সাদা রঙের একটা চক দিয়ে শেফার চারদিক বেশ কিছু জায়গা নিয়ে গোল দিয়ে ফেলেছেন, গোল দাগের চারদিকে বিদঘুটে কাচের জারগুলো সাজানো। আরজু সাহেব হটাত চমকে গেলেন, এ কি করছে তার বন্ধু! মফিজুল করিমের সাথে তার চোখাচোখি হল, আরজু সাহেবের মুখে দুঃখের ছাপ মফিজুল করিমের চোখ এড়াল না, তিনি মিস্টি করে আরজু সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি জানেন যে তার জীবন সায়াহ্ন উপস্থিত, তিনি আত্মার বদলে আত্মা উৎসর্গ করবেন। এ সোল ফর এ সোল।

সাদা গোল একটা দাগ, তার ভিতরে দুইজন মুখোমুখি হয়ে বসে আছে, মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে। মফিজুল করিম শেফার দিকে তাকিয়ে দ্রুত স্পেল উচ্চারণ করছেন। শেফার ঠোঁটের কোণে একটা ক্রূর হাসির আভাস দেখা যাচ্ছে যদিও সেটা মফিজুল করিমের চোখের ভুল হতে পারে। হটাত করে ঘরের মধ্যে একটা বাতাসের প্রবাহ বয়ে গেলো, মোমবাতিটা নিভতে গিয়েও কোনোমতে জ্বলে রইল। আরজু সাহেব বিস্ফোরিত চোখে দেখলেন সাদা দাগের চারপাশে থাকা জারের ভিতরের কুৎসিত বস্তুগুলো নড়তে শুরু করেছে, ঠিক জীবিত মানুষের হৃদপিণ্ডের মতো। প্রচণ্ড বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আরজু সাহেব ঘরের এক কোণা ধরে রেখেছেন, কিন্তু সাদা দাগের ভিতরের মানুষদুটো স্থির, অবিচঞ্চল। প্রচণ্ড শো শো শব্দকে ছাপিয়ে মফিজুল করিমের অদ্ভুত উচ্চারণ ঠিকই শোনা যাচ্ছে। ঠিক সে সময় মফিজুল করিম উঠে গিয়ে শেফার গলা চেপে ধরলেন, তার মধ্যে যেন ভর করেছে বুনো হিংস্রতা। শেফা চোখ বড় বড় করে মফিজুল করিমের দিকে তাকিয়ে আছে, ঘরের ঝড় থেমে গেছে, সেখানে শুরু হয়েছে অন্য রকম ঝড়। আরজু সাহেব দৌড়ে গিয়ে মফিজুল করিমের পিছন থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন, মফিজুল করিমের এক ধাক্কায় তিনি ঘরের এক কোণে ছিটকে গিয়ে পড়লেন। বাস্তবতা বুঝতে পারলেন আরজু সাহেব, বৃদ্ধ বয়সে তিনি শেফার চেয়েও দুর্বল।শেফা যেটুকু অবসর পেয়েছিল তার মধ্যে মফিজুল করিমের হাতের ফাঁক গলে বের হয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই মফিজুল করিম তাকে ফের ধরে ফেললেন। ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে একটা কাঁচের জার ফেটে গেলো, আরজু সাহেব আগ্রহভরে মফিজুল করিমের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আরজু সাহেবের ধারণা ঠিক ছিল, মফিজুল করিম শেফাকে ছেড়ে দিয়ে আরজু সাহেবের দিকে তেড়ে আসলেন। আরজু সাহেবকে কোন সুযোগ না দিয়েই তার টুটি চেপে ধরলেন। আরজু সাহেব ঝটপট করছেন, মফিজুল করিমের মতো বৃদ্ধের মাঝে এমন শক্তি অকল্পনীয়। মুহূর্তের মধ্যে শেফাও বুঝে গেলো তার কি করা উচিত, সে আরকটা কাঁচের জার ভাঙতেই মফিজুল করিম মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করে আরজু সাহেব কে ছেড়ে দিলো। শেফার দিকে তেড়ে আসার আগেই আরেকটা কাঁচের জার মফিজুল করিমের দিকে ছুড়ে মারল সে, জারটা মফিজুল করিমের মাথায় লেগে ফেটে গেলো। মফিজুল করিম কিছুক্ষনের জন্য থেমেই ফের তেড়ে আসার আগেই শেষ জারটা ফাটাল শেফা। মফিজুল করিম ধুপ করে মেঝেতে পড়ে গেলেন, আরজু সাহেব দ্রুত তার দিকে ছুটে গেলো। মফিজুল করিম জ্ঞান হারাননি, তিনি বসে চোখ পিটপিট করছেন, তার দৃষ্টি শেফার দিকে। শেফা দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে, মাত্র একদিনে তার জীবনে এতগুলো ঘটনা তার জীবনটাকে পুরো উল্টেপাল্টে দিয়েছে। মফিজুল করিম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, আলতো করে শেফার মাথা স্পর্শ করলেন। শেফা মুখ তুলে তাকাল না, আগের মতোই মেঝেতে বসে রইল। মফিজুল করিম আরজু সাহেবের দিকে মুচকি হাসলেন, পরিতৃপ্তির হাসি।
জানলার কাচ ভাঙ্গার প্রচণ্ড শব্দে শেফা চমকে মুখ থেকে দু হাত সরাল, আরজু সাহেব অশ্রুভরা দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন, মফিজুল করিম জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দিয়েছেন।

ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, শেফার জীবনটা এখন আগের মতোই স্বাভাবিক। যদিও রাতের অন্ধকারে এসব অতীত এসে জেকে ধরে, তবুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাই সে করে। মফিজুল করিমের কবর তার স্ত্রী কন্যার পাশেই করার ব্যবস্থা করেছিলেন আরজু সাহেব। মানুষটাকে খুব বেশি প্রশ্ন করেনি শেফা, তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মফিজুল করিমকে হারানোর কষ্ট ভুলতে তার সময় লাগবে। শুধু এটুকুই জানতে পেরেছিল যে আত্মার একটা বাহক লাগে। মফিজুল করিম শেফাকে বাঁচানোর জন্য নিজে সেই বাহক হতে চেয়েছিলেন, আর সাথে আত্মার শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্লাক ম্যাজিকের অংশ হিসেবে হৃদপিণ্ডগুলো ব্যবহার করেছিলেন। হৃদপিণ্ডগুলো ধ্বংস হলেও আত্মাটা ঠিকই মফিজুল করিমের ভিতরে ছিল, তাই তিনি আত্মহত্যা করেন, যাতে তার সাথে সাথে এই অপশক্তিরও মৃত্যু হয়। শেফার মাথায় একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত আরজু সাহেবের টেলিফোনে এজন্য সে কড়া নেড়েছিল। শেফা এটা বুঝতে পারছিল না, যে ডায়েরি নিয়ে এতটা সমস্যা সেটাকে কোনোভাবে পুড়িয়ে ফেললেই তো হতো! শেফার কথা শুনে ওপাশে আরজু সাহেবের সামান্য হাসির আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিলো, “ তুমি কি মনে করো আমরা সে চেষ্টা করিনি?” শেফার চোখ মাঝে মাঝেই মফিজুল করিমের বাড়ির দিকে চলে যায়, তার মনে হয় মফিজুল করিম তার দিকে হেসে হেসে হাত নাড়ছেন। শেফা চোখ কচলে ফের তাকায়, তারপর নিজের মনেই হেসে ফেলে, তার জীবনের আকাশের কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছে।

রাশেদ দোকানটা ঘুরে ঘুরে দেখছে, পুরনো বইয়ের ভাণ্ডার যেন পুরো দোকান। অথচ ক্রেতার দেখা প্রায় নেই বললেই চলে। পকেটে ফের হাত দিয়ে দেখল সে, অনেকগুলো টাকা জমিয়েছে গত কয়েক মাসে, বেশ কটা বই কেনা যাবে। দোকানদার তার পরিচিত, তার কাছে দাম একটু কমই রাখবে। হটাত করে বইটার দিকে নজর চলে গেলো রাশেদের, পুরু চামড়ায় মোড়ানো একটা বই। রাশেদের মুখে হাসি ফুটে উঠল, কেনার মতো ভাল একটা বই পেয়েছে সে। হাতে নিয়ে বইটার নাম পড়ার চেষ্টা করল সে,উপরের চামড়া কেটে লেখা রয়েছে- “দ্যা ওয়ান হু ডিসারভস ইটারনাল নলেজ”
( সমাপ্ত )
                                                   

Comments

Popular posts from this blog