গল্পঃ বৈশ্বানল

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন


বাসুমতি গ্রামের উত্তর কোণের পলেস্তারা খসা আলিশান বাড়িতে তখনও সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানো হয়নি। যোগেন ঠাকুর সন্ধ্যাহ্নিকের জন্য সবে বাইরের উঠোনে পা রেখেছেন। তুলসিতলায় পৌছাতে না পৌছাতেই বাইরের দরজায় কারো গলাখাকারি শোনা গেলো। যোগেন ঠাকুর হন্তদন্ত করে দরজা খুলেই দেখলেন বাইরে ঠাকুজ্জে মহাশয় গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। যোগেন ঠাকুর ভক্তি সহকারে তাকে ভিতরে এনে চেয়ার পেতে দিলেন, যদিও ঠাকুজ্জ মহাশয়ের বসার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। যোগেন ঠাকুর অবাক হয়েছে বটে, এমন অসময়ে ঠাকুজ্জে আগে কখনো তার বাটীতে এসে হাজির হয়নি। ঠাকুজ্জে মহাশয় তখনো দাঁড়িয়ে আছেন, তুলসিতলার দিকে তাকিয়ে প্রথম মুখ খুললেন।
“ অ্যা!! এখনো প্রদীপ দাওনি! ঘরে ধুনো দেবে কখন শুনি? এ কি অনাচার পড়ল বাপু!”
কঙ্কন রানী ঘোমটা দিয়ে দ্রুত প্রদীপ জ্বালালেন। যোগেন ঠাকুর লজ্জায় মাথা নত করে আছে। গ্রামের সকলে তাকে খাটি ব্রাহ্মণ বলে চেনে। পুজোয় কখনো তাকে ক্ষণকাল পার হওয়ার পরে আসতে দেখেনি। আর আজ কিনা ঠাকুজ্জে এসেই!! আনমনে জিভ কাটলো যোগেন।
“ বিশ্বমিত্র কই! ডাকো দেখি ছোকরাকে। জ্ঞান ভান্ডার কেমন বাড়ছে একটু পরখ করে দেখি।“ ঠাকুজ্জের কথায় হুঁশ ফিরল যোগেনের। ছেলের খোঁজ সে বিকেলেও করেছে, কঙ্কন রানী খবর দিতে পারেননি। এই বয়সেই ভারী বেয়াড়া হয়ে উঠেছে, নইলে এমন রাত বিরেতে বাইরে থাকে কে! যোগেন ঠাকুরকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠাকুজ্জে মহাশয় ফের তাড়া দিলেন।
“ কই গো! ডাকো তোমার সুপুত্রকে!” ঠাকুজ্জের কথা শুনে হুট করে নতুন একটা কথা মনে আসলো যোগেন ঠাকুরের। ঠাকুজ্জে যে সব কাজে নাটকীয়তা পছন্দ করে এ সবার জানা। সেবার করিম কসাইকে গ্রামছাড়া করার সময় যে নাটক করেছিলো! কেউ কিচ্ছু বোঝেনি! কথাটা মনে হতেই বুকটা কেঁপে উঠল যোগেনের। বিশ্বমিত্র কোন অঘটন ঘটায়নি তো। যোগেন ঠাকুর চুপ করে রইল।
“ অ্যা! নিজের ছেলে কি করে বেড়ায় সেসব খবর তোমার কানে আসে না? যত সব স্লেচ্ছাদের সাথে রাতদিন টো টো করে ঘোরে। এমুন করলি কিডা তোমাদের বামুন বলবি বল দেখি।“
যোগেন ততক্ষণে বুঝে গেছে, কোন না কোন অঘটন বিশ্বমিত্র ঘটিয়েছে, সে কারণেই সূর্য ঢলে পড়ার পরও আজ সে বাটীতে ফেরেনি।
ঠাকুজ্জে মশাই আয়েশ করে চেয়ারে বসলেন। কঙ্কন রানী ততক্ষণে গোটাকয়েক লুচি আর বেগুনভাজা রেখে গেছেন। এখানা লুচি বেগুনভাজার সাথে পেটে চালান করতে করতে ফের কথা শুরু করলেন ঠাকুজ্জে।
“ গ্রামে থাকো। চারপাশে স্লেচ্ছায় ভরা। এসব স্লেচ্ছা থেকে জাতপাত টিকিয়ে রাখতে হবে তো। সেখানে বামুনের ছেলে হয়ে যদি তোমার ছেলে স্লেচ্ছাদের সঙ্গে মিশে আরেক বামুনের ছেলেকে ধরে মারে তাহলে কেমন দেখায়!” ঠাকুজ্জের কথায় চমকে উঠলো যোগেন, ব্যাপারটা সে পুরোপুরি বুঝতে পারছেনা।
“ বিশ্বমিত্র বামুনের ছেলেকে মেরেছে!!”
“ তা আর বলতে” বাকি লুচিটুকু চালান করতে করতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল ঠাকুজ্জে মহাশয়। “ শুধু মারেনি, মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে।“ যোগেন বসু বুঝতে পারছেন তার রাগ হচ্ছে, কিন্তু সেটা বিশ্বমিত্রের প্রতি নাকি ঠাকুজ্জের উপর সেটা ঠাওর করতে পারলো না।
“ আহা! কি সোয়াদ! বউমার হাতে জাদু আছে বৈকি।“ ঠাকুজ্জের কথা শুনে এবার যারপরনাই বিরক্ত হল যোগেন, আসল কথা থেকে সরে গিয়ে প্যাচাল টানতে যে এ বুড়ো ওস্তাদ তা তার বেশ ভালো করেই জানা।
“ হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দক্ষিণ পাড়ার সুধাময়ের ছেলে বিশু, চেনো তো! বিশু এক দুলেকে ঠেঙ্গাচ্ছিল। ওই যে কান্তি দুলে! ব্যাটা মহা হারামজাদা, কাজে খুব ফাকি দেয়, ঠেঙ্গানোই দরকার। তোমার ছেলে গিয়ে বিশুর হাতের হুড়কো কেড়ে নিয়ে বিশুকেই মেরেছে। কি চাঁদবদন মুখখানা, মেরে লাল করে দিয়ে মহাকেলেংকারি ! সুধাময় তো ক্ষেপে পুলিশ-টুলিশ ডাকবে! আমিই শেষে বোঝালাম। এখন বল দিকিনি, আমরা এ ক ঘর বামুন যদি নিজেরাই হাভাতে করে মরি, লোকে নিন্দে করবিনানে?”
ঠাকুজ্জের কথা শুনে এতক্ষণ স্থাণু হয়ে বসে ছিল যোগেন, এতো কিছু ঘটে গেছে আর তিনি কিছুই জানেন না। এখন বেশ বুঝছেন হাটে আজ সুধাময় তাকে দেখেও না দেখার ভান করল কেন।
“ তোমার পুত্রের যে হাবভাব দেখছি তাতে যে শাস্ত্রজ্ঞান কিছু আছে বলে তো মনে হয়না, নাহলে ওরকম স্লেচ্ছাদের সাথে মেলামেশা তো সুলক্ষণ নয়।“
যোগেন চুপ করে রইল, এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। ঠাকুজ্জে মহাশয় উঠে দাড়ালেন।
“ তাহলে ওরে একটু চোখে চোখে রেখো বাপু। আজকালকাল ছেলেরা একেকটা মুখ্যু হয়ে জন্মাচ্ছে...” যোগেন ঠাকুর ঠাকুজ্জে মহাশয়কে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

রহমতের বাড়িতে অনেকক্ষণ বসে ছিল বিশ্বমিত্র। রহমতের মা অনেক ভালো মোয়া বানায়। বাড়িতে যাবার সাহস করে উঠতে পারছেনা সে। যোগেন ঠাকুর বাইরে শান্ত হলেও ভিতরে ভিতরে বেশ রাগি, এটা বিশ্বমিত্র ভালো করেই জানে। কিই বা দোষ ছিল বিশ্বমিত্রের! ঐ বিশু, বিশ্বমিত্রের এক কেলাস নিচে পড়ে, গর্বে তার মাটিতে পা পড়ে না। অতো বুড়ো কান্তি কাকাকে এমনভাবে মারলে! বিশুর পিঠে দু-চার ঘা লাগিয়েছে, বেশ করেছে। কিন্তু যোগেন ঠাকুর কি আর এতো সব বুঝতে চাইবেন!

বাড়ির পুব দিকের ভাঙা দেয়ালে পা গলিয়ে লাফ মেরে বাটীর ভিতরে ঢুকল সে। যোগেন ঠাকুরের অম্বলের ব্যাথা আছে, সন্ধ্যে নাগাদ শুয়ে পড়েন। সেই ভরসাতেই বাড়ি ফিরেছে এখন। বাইরের উঠোন পেরিয়ে রোয়াকে পা রাখতেই যোগেনের গম্ভীর স্বর শোনা গেল,” দাড়াও!”
পিলে চমকে ওঠার মতো চমকে উঠল বিশ্বমিত্র। বাবা যে এতো রাত্রে জেগে থাকবে এটা সে ভাবতে পারেনি। জোছানার রাত হলেও চাঁদ প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে, অল্প অল্প আলো দিচ্ছে। বিশ্বমিত্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আজ তার কপালে যে শনি আছে তা বলে দিতে হবে না। যোগেন ঠাকুর এগিয়ে এসে ছেলের আপাদমস্তক নিরিখ করলেন। গিলটি করা ধুতির এককোণা ছিড়ে ঝুলছে। পরণের জামারও জীর্ণ অবস্থা। মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে যোগেন ধারণা করলেন বিশ্বমিত্র ভয় পাচ্ছে।
“ বেহাল্লাপনার খবর তো হাওয়ায় ভেসে কানে আসছে। বামুনের ছেলে হয়ে যদি এসব করে বেড়াও তাহলে আশেপাশের দু চারটে মানুষের সামনে মুখ দেখাব কি করে বল দিকিনি।“
বিশ্বমিত্র চুপ করে রইল, এ অবস্থায় কথা বলাও বিপদজনক। যোগেনের গলা খাকারি দিয়ে বললেন,” ঘরে যাও! কাল সুবীরবাবুর সাথে আমি কথা বলব।“

বিশ্বমিত্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল, দ্রুত পায়ে ঠাকুরঘরের দিকে দৌড়ে গেলো সে। সুবীরবাবুর কথা হটাত মনে হল বিশ্বমিত্রের। ইস্কুলে নতুন বদলি এসেছেন,মধ্যবয়স্ক, বাড়ি চাটগার দিকে। অল্প কদিনেই সুবীরবাবুকে প্রচণ্ড পছন্দ করে ফেলেছে বিশ্বমিত্র। সুবীরবাবুর আচরণ দেখেও বোঝা যায় তিনি বিশ্বমিত্রকে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ভাবেই দেখেন।বেশ কবার বাড়ি এসে যোগেন ঠাকুরের সাথে দেখাও করে গেছেন। বিশ্বমিত্র এবার নয় কেলাসে উঠেছে, ও পাড়ার বিপিন ঠাকুর ইস্কুলের কোন মাস্টারকে নাকি বাড়ি এনে প্রাইভেট পড়ান। যোগেন মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুবীরকে দিয়ে বিশ্বমিত্রকে প্রাইভেট পড়াতে, সুবীরবাবু রাজি হননি। প্রস্তাব শুনে হাতজোড় করে বলেছিলেন,” আজ্ঞে, আমি জতটুকু জানি ওকে জানিয়ে যাব, এজন্য আলাদা কিছুর দরকার নেই।“

সুবীরবাবুর কাছে অনেক কিছু শিখেছে বিশ্বমিত্র। বাসুপতি গ্রামের পাশেই মরা গাঙ। বর্ষার পরপরই এ গাঙে জোয়ার আসে। গাঙের পাশেই জন্মায় ঘন কাশফুলের ঝাড়। সুবীরবাবুর সাথে গল্প করতে করতে এই গাঙের ধারে যায় বিশ্বমিত্র। এইতো সেদিন,গাঙের পাশ বসে সুবীরচন্দ্র ওকে জাতভেদ বোঝাচ্ছিলেন। গাঙ থেকে হাতের চেটোয় জল তুলে নিয়ে তিনি বিশ্বমিত্রের দিক ধরলেন।
“ এই দেখো বিশ্ব, এ জল জাতপাত মানে না। অথচ এই জলেও আমরা জাত ঢুকিয়ে দিয়েছি। জল তো জলই, এর আবার জাত কি!”
সুবীরবাবুর কথা শুনে সেদিন খুব অবাক হয়েছিলো বিশ্বমিত্র। সত্যিই তো! এভাবে আগে কখনো তো সে ভেবে দেখেনি। হাতের চেটোয় জল তুলে নিয়ে সেদিন সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। জল কি জাতপাত মানে? কই না তো! তবে মানুষের মাঝে জাত নিয়ে এতো হানাহানি কেন? প্রশ্নটা সে সুবীরবাবুকে করেছিল। সুবীরবাবু উত্তর দেননি, শুধু ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে মৃদু হেসেছিলেন।

আজকে সুবীরবাবুর কথাটা খুব মনে পড়ছে, জল তো জাতপাত মানে না। রহমতের বাড়িতে গিয়ে ও কত কিছু খেয়েছে, ওর মাকে কখনো হাসিমুখ ছাড়া দেখেনি। অথচ সেদিন রহমত ওর বাটীতে আসতেই মা ওর সামনেই গোবরজল ছিটাতে লাগলেন। খুব লজ্জা পেয়েছিল বিশ্বমিত্র সেদিন, রহমতের সামনে মাথা তুলে কথাই বলতে পারেনি। বিছানায় শুয়েও বিশ্বমিত্রের মাথায় একই কথা ঘুরপাক খেতে লাগল, জল তো জাতপাত মানে না, মানুষ কেন মানে!

বাজারের দক্ষিণ পাশে তাসের আড্ডা দেয়ার জন্যই ছনের ঘরখানা তোলা। আগে আশেপাশের দশ গ্রামে কোন ক্লাবঘর ছিল না। এই ছনের ঘরটাকেই ক্লাবঘর বানানো হয়েছে। ঘরের ভিতরে সস্তা বিড়ির বাজে গন্ধ, যোগেন তার মধ্যে নাক সিটকে বসে আছে। লোকজনের জমায়েত তখনও হয়নি,বিশ্বমিত্র ক্লাব ঘরের পিছনের জানালায় উবু হয়ে বসে আছে। সকালবেলাতেই হটাত যোগেন যখন হন্তদন্ত করে বাইরে বেরিয়ে গেলো, বিশ্বমিত্র তার পিছু ছাড়ার লোভ সামলাতে পারেনি। থাকুজ্জে মশাই আয়েশ করে পান চিবুচ্ছেন, তার পাশেই সুধাময় ঠাকুর হুকা নিয়ে বসে আছে। জানলাটা ছোট, তবু তার মধ্যে দিয়ে ভিতরে কি ঘটছে দেখার চেষ্টা করল বিশ্বমিত্র। ঘরের এককোণায় কান্তে দুলেকাকার সাথে কাকিকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল সে। ভিড়ের এককোণে রহমতও দাঁড়িয়ে আছে। যোগেন ঠাকুর ঠাকুজ্জে মহাশয়ের দিকে একটু এগিয়ে গেলেন।
“আজ্ঞে, আসলে হয়েছেটা কি? সকালে হটাত করে জরুরি তলব করলেন।“ থাকুজ্জের পান চিবানোয় ব্যাঘাত হওয়ায় তিনি সামান্য বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন।
“ বিশু গো বিশু” ঠাকুজ্জের কথা শুনে অবাক হলেন যোগেন, বিশু আবার কি করল!
“ দেখতে হবে না! বামুনের ছেলে, বামুনের তেজ রক্তে রক্তে।“ যোগেন ঠাকুর চুপ করে রইলেন। পারতপক্ষে তাকে যে অপমান করা হচ্ছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।
“ বিশু পণ করেছে, কান্তেকে গ্রাম ছাড়া না করা পর্যন্ত সে জল-দানা স্পর্শ করবে না।“ ঠাকুজ্জের কথা শুনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল যোগেন। কান্তেকে সে আজ থেকে চেনেনা,তার বাবার আমল থেকে কান্তেকে নিজের বাড়ি কাজ করতে দেখেছে। হাফপ্যান্ট পরে কালো, অস্থিচর্মসার এই লোকটা একাই পুরো গোলাবাড়ি সামলাত। আজ সেই কান্তেকে সামান্য কারণে গ্রামছাড়া করা হবে! যোগেনের মুখ দেখে মনের ভাব বুঝতে খুব একটা কষ্ট হল না ঠাকুজ্জের। ঈষৎ হেসে তিনি যোগেনের দিকে সরে এসে ফিসফিস স্বরে বললেন, “ দেখো বাপু, কান্তের সামনে যা হয়েছে তাতে বিশু চারদিক মুখ দেখাবে কি করে ভেবেছ? এতে যদি এখন বিশ্বমিত্রকে জড়িয়ে ফেলি, ব্যাপারখানা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে না।“
ঠাকুজ্জের কথা শুনে যোগেন চোখমুখ শক্ত করে রইল। ঠাকুজ্জের কথা মিথ্যা নয়, কিন্তু সেজন্য কান্তেকে!! যোগেনকে চুপ করে থাকতে দেখে একগাল হেসে নিজের জায়গায় ফিরলেন ঠাকুজ্জে মহাশয়। ‘গ্রাম ছাড়তে হবে’ কথাটা তোলার পরপরই কান্তে দুলে এসে নতজানু হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুজ্জের পা জড়িয়ে ধরল।
ঠাকুজ্জে আঁতকে উঠলেন,” করলি কি! করলি কি! ছুঁয়ে দিলি তো।“ কান্তে বিকারগ্রস্থের মতো মাথা ঠুকরে কাঁদতে লাগল।
জানলা দিয়ে এতক্ষণ সবকিছুই দেখছিল বিশ্বমিত্র। হিতাহিত জ্ঞানশুন্যের মতো একদৌড়ে গাঙের ধারে এসে থামল সে। বিশ্বমিত্র অবাক হয়ে দেখল সে ফুঁসছে, হাতের মুঠি বারবার শক্ত হয়ে আসছে, গলায় কি যেন একটা দলা বেঁধে আছে। বারবার ঢোঁক গিলেও তা নামানো যাচ্ছেনা।

সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষন আগে। বিশ্বমিত্র আজ আর ঘরের বাইরে বের হয়নি। যোগেন ঠাকুরও ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন, একটা তিক্ত অপরাধবোধে তিনি ঘুমাতে পারছেন না। সুবীরবাবুর বলা কথাগুলো খুব মনে পড়ছে বিশ্বমিত্রের। জলের কোন জাতপাত নেই, বায়ু যখন জাতপাত মেনে আসে না, মানুষের কেন এতো জাতের পার্থক্য। রহমতের কাছে শুনেছে, সন্ধ্যায় নাকি কান্তে চলে যাবে। কান্তেকে কেন গ্রাম ছাড়তে হবে, সে তো কোনো দোষ করেনি। শুধু নিচু জাতের বলে তাকে আজ এই অন্যায় মেনে নিতে হবে? অন্যায়? হ্যাঁ, অন্যায়ই তো। আচ্ছা, তার জায়গায় সুবীরবাবু থাকলে কি করতেন? তড়াক করে উঠে বসল বিশ্বমিত্র, সে জানে তাকে কি করতে হবে।
যোগেন ঠাকুর দাওয়া থেকে তখন শোবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। বিশ্বমিত্রের ঘরের দরজা খুলে গেলো। তীব্র গতিতে বিশ্বমিত্র যোগেনের সামনে দিয়ে বাটীর বাইরে চলে গেলো। যোগেন ঠাকুর বাঁধা দিলেন না, যা তিনি করতে পারেননি, তার ছেলে তা করুক।

বড় রাস্তা দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে বিশ্বমিত্র। কান্তেকে তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে। রাত্রিদেবী নতজানু হয়ে প্রকৃতিকে প্রণাম জানাচ্ছেন। বিশ্বমিত্র কি জানে, অন্ধকারে সবাইকে একই রকম দেখায়? সে, যোগেন ঠাকুর, ঠাকুজ্জে মহাশয়, কান্তে, রহমত, সবাই এক রকম!তাইতো নিশি এ পৃথিবীর এক অমলিন সৌন্দর্য। সেই অমানিশায় ছুটে চলেছে এক কিশোর, বুকে তার চাপা অনল, বৈশ্বানল।
                                          

Comments

Popular posts from this blog