গল্পঃনরকের ফুল

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

২য় পর্ব

চিৎকার থেমে যায়। ওখান থেকে দ্রুত পা চালায় আনিস, তীব্র অপরাধবোধে ভুগছে সে। মফিজ বাড়ি থেকে গজগজ করতে বেরিয়ে আসে।
“ মা*র আমার দিয়ে হয়না, নাগর দের লগে লাইন মারে, দাড়া, তোর পার্মানেন্ট ব্যাবস্তা করতিছি।“
এসব কথার কোন কিছুই কানে যাচ্ছে না, অর্ধমৃত হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে সে। পাশেই জোছনা তারস্বরে কাঁদছে। মেয়ের কান্না শুনে সচকিত হয় লাল বানু, আলুথালু কাপড় গুছিয়ে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। লাল বানুর সামনে সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসছে, জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে। জ্ঞান যখন ফিরল তখন ফিরোজার মা তার গায়ের রক্ত মুছিয়ে দিচ্ছে, জোছনা রহিমার কোলে ঘুমুচ্ছে।
“ কি গো ভাবী? কান্দ কেন?”
“ কান্দি কি আর সাধে, তুই মরবার পারস না, আর কত মার খাইবি।“
ম্লান হাসার চেষ্টা করে লাল বানু ,পরক্ষনে মুখ বিকৃত হয়ে যায় ।
পরের দিন ঘরের রোয়াকে মাদুর পেতে শুয়ে ছিল লাল বানু। তীব্র জ্বরে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে তার। ঠিক সে সময় বাড়িতে আনিস আসলো। তার মুখ দেখেই বোঝা যায় প্রচণ্ড অনুতপ্ত সে।
“ আনিস ভাই, ভালা আছেন নী?”
আনিস কথা না বলে মাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। লাল বানু উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু তীব্র ব্যাথায় তার আর ওঠা হয় না। বহু কষ্টে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে।
“ কি হইল আনিস ভাই, কথা কন না ক্যা? উনার লগে দেখা হয়ছে?”
আনিস এবার ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকায় লাল বানুর দিকে। মুহূর্তের জন্য লজ্জায় কেঁপে ওঠে লাল বানু।
“ আফনি কেমন আছেন?”
নিতান্ত অবান্তর প্রশ্ন, প্রশ্ন শুনে হাসে লাল বানু।
“ যেমন তিনি রাখছেন।“ কণ্ঠে স্পষ্ট ব্যাঙ্গের ছাপ।
অপ্রস্তুত হয়ে যায় আনিস। লাল বানুর দিকে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সে। গালে আঙ্গুলের দাগ কালশিটে হয়ে স্পষ্ট হয়ে আছে, হাতে ক্ষত ঢাকার চেষ্টা করলেও নিজ উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সে।
“ আমারে মাফ কইরা দিয়েন, আজ আমার ল্যাইগা আজ আপনার এ অবস্তা।“
“ ছি ছি আনিস ভাই, আপনি মাফ চান ক্যা! আপনার তো কুনো দোষ নাই। সে মানুষডাই ওরকম।“
“ তাও ভাবী, আমি পানি না খাইতে চাইলে ইরাম হত না।“
“ আরেক গেলাস খাবেন নাকি?” প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলে লাল বানু।
লাল বানুর হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় আনিস। সেও হেসে ফেলে। আনিসের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায় লাল বানু।
“কিছু মনে নিয়েন না , মফিজ ভাইরে দেখলে মাঝে মাঝে ভাবি, হেই মানুষ না জানোয়ার।“ কথাটা বলেই জিভ কাটে আনিস “ রাগ কইরেন না ভাবি, মুখ ফস্কায় বেরোয় গেছে।“
লাল বানু রাগ করেনি। মানুষকে জানোয়ার বললে রাগ করা যায়, জানয়ারকে জানোয়ার বললে রাগ করা হয়ে ওঠে না। আনিসের দিকে হেসে বুঝিয়ে দেয় যে সে রাগ করেনি। ঘরের ভিতর থেকে জোছনা কেঁদে ওঠে। কষ্টেসৃষ্টে জোছনাকে কোলে নিয়ে বাইরে আসে লাল বানু।
“ কি সুন্দর চাঁদের লাহান মাইয়া আফনার! একদম আফনার মত দেখতে হয়ছে, আফনার মতই সুন্দর।“
এবার খুবই লজ্জা পায় লাল বানু। আঁচল দিয়ে মুখ দেখে বলে” কি যে কন না আনিস ভাই। আমার শরম করতাছে।“
লাল বানুর বয়স যদি হিসাব করা হয় তবে এখনো তা বিশের কোঠাতেও পৌঁছায়নি। যৌবনের প্রকৃত স্বাদ তখন কেবল মাত্র পেতে শুরু করেছে সে। কিন্তু সে আকাংক্ষিত স্বাদ অনাকাংখিত ভাবে যে অন্য দিক থেকে আসবে তা কারো জানা ছিল না ।
“ আনিস ভাই, আপনি আইজকা আসেন, উনি বাড়িত আইব”

এ কথা শোনা মাত্র হন্তদন্ত হয়ে ছোটে আনিস। সে দৃশ্য দেখে আনমনেই হেসে ওঠে লাল বানু, মায়া হয় বেচারার জন্য। সেদিন মফিজ বাড়ি এসে বউকে আর মারধর করেনি, মরে গেলে সমস্যা, পুলিশ এসে ঝামেলা করতে পারে। মনে মনে ভাবে মফিজ, পুব পাড়ার জরিনার সাথে আজকাল খুব ভাব হয়েছে তার। সেদিন মেলা থেকে লালপেড়ে শাড়ি আর আলতা কিনে দিয়েছে জরিনাকে। জরিনারকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়ায় তার এক কথা- “ বাড়িত বউ রেখে বিটা মানুষ আবার বিয়ে করতি চায়, ইস! শখ কত!” বলেই হেসে ফেলে জরিনা, সে হাসি প্রশ্রয়ের হাসি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মফিজ, লাল বানুরে যে করেই হোক তাড়াতে হবে। তাতে যদি কলঙ্কের কালিও মাখাতে হয়, সে ব্যাবস্থা সে করবে।
“ কাল সক্কালবেলা কিডা আইছিল রে?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে ফিরোজার মা। লাল বানু কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়” কই, কেও তো আহে নাই” । তার কথায় অস্থিরতা বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়, উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারে না ফিরোজার মা।
“ তোর সোয়ামি তো পুব পাড়ার জরিনা মা**র লগে ঢলাঢলি করে, খোঁজ খবর কিছু রাখস। গেরামের বেবাক লোকে নানা জন নানা কথা কয়, আমি বিশ্বাস করি নাই। হেইদিন নিজ চক্ষে দেখছি।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাল বানু, এই কথা তার কানে আগেও এসেছে। কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না লাল বানুর। সেদিন রাতে বাংলা মদ খেয়ে বাড়ি এসে আবার গায়ে হাত তোলে মফিজ, তার সাথে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই। নিজ মেয়েকে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে ঘরের এক কোণে রাত পার করে লাল বানু। পরের দিন অফিসে যাওয়ার পরপরই আবার আনিস আসে। এবার সে খালি হাতে আসে নি, সাথে এনেছে একটা লাল শাড়ি আর কাঁচের চুড়ি।
“ ভাবি বাড়িত আছেন?”
আনিসের গলা শুনে দৌড়ে বাইরে বের হয়ে আসে লাল বানু। এত দ্রুত বের হয়ে আসায় নিজেই লজ্জা পায় সে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তার খোঁড়ানো দেখে আনিসের বুঝতে বাকি থাকে না কাল রাতে কি অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে তার উপর। থমকে দাঁড়িয়ে থেকে সে, তারপর হাতের শাড়িখানা বাড়িয়ে দেয় লা বানুর দিকে।
“ এইডা কি আনিস ভাই? শাড়ি আনছেন কাল ল্যাইগ্যা!”
“ গতদিন পুব পাড়ার মেলায় গেছিলাম, আপনের কথা মনে হইল তাই আনলাম।“
“ মাফ কইরেন আনিস ভাই, এ আমি নিবার পারমু না, উনি দেখলে….। আপনি ভাবির জন্য নিয়ে যান।“
লাল বানুর কথা শুনে মৃদু হাসে আনিস, “ ভাবি পাইলেন কই, বিয়া- শাদি করবার সময় পাই নাই। শাড়িটা রাখেন, বড় আশা কইরা আনছি আপনার জন্য। “
লাল বানু শাড়িখানা নেয় তারপর স্বার্থপরের মত বলে ওঠে” আপনে যান আনিস ভাই, আর আইবেন না।“
চোখের জল গোপন করে শাড়িখানা বুকে চেপে ধরে ঘরের ভিতরে দৌড়ে চলে যায় লাল বানু। আনিস হতভম্ব হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, বাঙালি নারীর এই ছদ্মরুপের সাথে তার পরিচয় নেই। ধীরে ধীরে চলে যায় আনিস। লাল বানু চেয়ে থাকে আনিসের চলে যাওয়া পথের দিকে, এমন কঠিন ভাবে না বললেও পারত সে। লাল বানু কখনো মনের দুঃখে কাদে না, এ জন্যই বোধহয় তার চোখ অল্পতেই ভিজে যায়।

রাতে মফিজ বাড়ি আসে, তার রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়েই লাল বানু বুঝতে পারে আজ রাতেও তার নিস্তার নেই। একটানা চলে তার উপর অকথ্য নির্যাতন। জ্ঞান হারায় লাল বানু, জ্ঞানহীন দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় মফিজ, আজ তার মাথায় খুন চেপেছে। জরিনাকে আজ আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল মফিজ, জরিনা স্রেফ না বলে দিয়েছে। তার মতে, মদ্দা মানুষের কোন বিশ্বাস নেই। সেই রাগ এখন মফিজ লাল বানুর অচেতন দেহের উপর ঝাড়ছে। প্রচণ্ড মার খেয়েই যেন আবার জ্ঞান হয় লাল বানুর। দরজায় কে যেন ধাকাচ্ছে। মফিজ দরজা খুলে দেখে ফিরোজার মা দাঁড়িয়ে। ফিরোজার মা হন্তদন্ত করে ঘরে ঢোকে
“ তোর এ কি কাজ মফিজ! মাইয়াডারে বাঁচবার দিবি না নাকি!”
“ চাচি আপনি যান” নেশাগ্রস্থ মফিজ চেঁচিয়ে ওঠে।
“ তুই বের হ, আমি লাল বানুরে দেখতাছি।“
নেশার ঘরে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে মফিজ আবার চেঁচিয়ে ওঠে, “ ওই চু**মারানি, যাইবার কইছি না।“
নিজের ছেলে বয়সী কারো কাছে এমন ভাষা শোনার পর আর কারো পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব হয় না, ফিরোজার মা মুখে আঁচল গুঁজে বের হয়ে যায়।

লাল বানু দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চাহনিই বলে দেয় সে কারো দর্শনপ্রার্থী। কিছুক্ষণ পরপরই বাইরে উকি মেরে দেখছে উঠানে কেউ এসেছে কি না। কেই বা আসবে। যার আশায় এত ব্যাগ্রতা তাকে তো কাল একপ্রকার তাড়িয়েই দিয়েছে লাল বানু, তবে কেন বার বার উঠানে চোখ চলে যাচ্ছে। লাল বানু নিজেকে প্রশ্ন করে, উত্তর পায় না।
“ বাড়িত আছেন?”
কণ্ঠস্বর শোনামাত্র লাল বানু চমকিয়ে ওঠে, দৌড়ে চলে আসে রোয়াকে। আনিস ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লাল বানুর মনে হল প্রশান্তির একটা স্পর্শ সারা দেহে ছড়িয়ে গেল তার। কিন্তু বাঙালি নারীর মণ বোঝা দায়। হয়ত বলতে চেয়েছিল, আপনি আইছেন? তার বদলে বলে ফেলল-
“ আপনি ফের আইছেন?”
লাল বানুর প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে যায় আনিস। ইতস্তত করতে থাকে।
“ না মানে , এদিক দিয়াই যাইতেছিলাম, ভাবলাম আপনার লগে দেখা করে যায়।“ আনিস মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, লাল বানু কাঁদছে। সে কান্নায় কোন ক্লেদ নেই, কোন জড়তা নেই ,হয়ত একরাশ অভিমান ছিল কিন্তু সে আবেগ বোঝার ক্ষমতা পুরুষের নেই। কি করবে বুঝতে পারে না আনিস।
“ আইজক্যা আসি “
লাল বানু কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে আগ্রহ নিয়ে বলে,” পানি খাইবেন না?”
লাল বানুর কথা শুনে হেসে ফেলে আনিস, নির্মল হাসি।
(চলবে)
                       

Comments

Popular posts from this blog