গল্পঃ ২৮ দিনের নরকবাস

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

পিছনে ধেয়ে আসছে দানব। টিক টিক করে তার কাছে ধেয়ে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাড়ছে হৃদস্পন্দন , এই বুঝি ঘাড়ে এসে পড়ল সেই দানব। ঘর্মাক্ত দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে তবু সামনে নিয়ে যাচ্ছি। ওই তো সামনে সীমানা দেখা যাচ্ছে। সামনের দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তবু পৌছাতেই হবেই। সীমানা ছুঁয়ে ফেলেছি প্রায়। আর একটু... ঠিক সেই মুহূর্তে দানবের ঢং ঢং ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। লুটিয়ে পড়ল দেহ। তবে কি আর সীমানায় পৌঁছানো হল না! না, এ কোন সায়েন্স ফিকশান নয়। এটা এস এস পরীক্ষার্থীর গল্প। না, কোনদিকেই বাড়িয়ে বলছি না, একজন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা এর চেয়ে বেশি বৈকি কম ভীতিকর নয় । একজন এস এস সি পরীক্ষার্থী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাটা জানাতে পারলে হয়ত দুঃখ আর সেই দুঃসহ সৃতির যন্ত্রণা কিছুটা হলেও হয়ত লাঘব হবে। সেই জন্য আমার এই লেখা। নরক যন্ত্রণা মানুষ পরকালে পাবে জানি, কিন্তু তার নমুনা আমরা ইহকালেই পেয়ে গেছি, বলাই বাহুল্য যে তা এস এস সি পরীক্ষার দরুন ই সম্ভব হয়েছে।
দীর্ঘ ২৮ দিনের যুদ্ধের পর দেহে না থাকলেও আমাদের মনে রয়ে গেছে ক্ষত । প্রমথ চৌধুরী ঠিকই বলেছিলেন। দেহের মৃত্যুর রেজিস্ট্রি রাখা হয়, আত্মার নয়। আমাদের আত্মার এ ক্ষত শুধু আমরাই দেখতে পাচ্ছি, অন্যদের দৃষ্টিতে তা বাঁধছে না। ২রা ফেব্রুয়ারি, নরকবাসের সূচনা হল সেদিন। যতটা না পরীক্ষার দুশ্চিন্তা তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হল পরীক্ষার পর ভুল হলে বাবা মা কি বলবে, একেবারে সিন্দাবাদের ভুতের মত ঘাড়ে চেপে বসত এই চিন্তা। বাংলা ১ম পত্রে নৈব্যেত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। তামিম ইকবাল হাতে ব্যাথা পেয়েছেন কিন্তু সেই ব্যাথার তোপটা সামলাতে হচ্ছে আমাদের। পরীক্ষার হল থেকে বের হলাম, মনে হল হাবিয়া থেকে লাযামাহ তে আগমন হয়েছে। অভিভাবকের সমালোচনা, সে পেরেছে তুমি পারনি, সে ভাত খায়, তুমি খাও না…এমন সব কথা শুনে মন আর পরের পরীক্ষা দেয়ার জন্য সায় দেই না, তবু যেতে হয়। তবে হ্যাঁ, ভাল করে যদি খেয়াল করা হয়, তবে দেখা যায় যে পরীক্ষার হলেও নানা মজাদার ঘটনা ঘটে। যেমন ইংরেজি ১ম পত্রের দিন যে ম্যাডাম ছিলেন তিনি সারাটা সময় অতি যত্ন সহকারে তার নাক পরিষ্কার করছিলেন। সেদিন তাকে পেয়ে আমরা বড়ই আনন্দে ছিলাম। বাধ সাধল পরের দিন। কোন এক বেচারি হাত দিয়ে তার চোখদ্বয় কে আড়াল করে কার খাতা দেখছিল। সেদিন যে ম্যাডাম পরেছিলেন তিনি তা দেখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, নকশা কর না, তুমি আমার সাথে নকশা কর!!! তার এই আকস্মিক চিৎকার শুনে জানলায় বসে থাকা পাখিটারও প্রায় কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিল। আমি মিনমিন করে বললাম, ম্যাডাম, আজকে ইংরেজি, নকশা নেই। তিনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন তিনি সকালে নাস্তা করে আসেন নি, আমাকে দিয়েই কাজটা সারবেন। আমি চুপসে গিয়ে আমার সাদা খাতার সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। গনিত পরীক্ষার দিন মাথা কাজ করছে না। ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম মাথা দিয়ে ভাপ উঠছে। ঠিক সেই সময় এক ছেলে এসে বলল, ভাই, এই আমার গার্লফ্রেন্ড, একটু দেখায়েন। মেজাজখানি টং করে উঁচুতে উঠে গেল, তারপরও বিনয়ে গলে গিয়ে একগাল হাসি দিয়ে বললাম, জি ভাইজান, আপনি বলেছেন আর আমি করব না! আপনার জন্য আমি যান পর্যন্ত কুরবান করতে রাজি আছি।
প্রহর গুনছি, ২৩ তারিখ, এই তো চলে এল। ঠিক সেই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত খবর এলো, পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। ভাবলেশহীন চোখে শুধু উপরের দিক তাকিয়ে বলেছিলাম, হে আল্লাহ, তোমার কাছে ফরিয়াদ, বল কি অপরাধ। তারপর এলো সেই স্মরণীয় পরীক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আচ্ছা, কে জীবনে একই পরীক্ষা একই শিক্ষাবর্ষে ৩ বার দিয়েছে? আমি দিয়ছি, আমার মত অসংখ্য বেচারা দিয়েছে। প্রথমে প্রশ্ন ভুল, পরে ক সেটের প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে দেখে পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে তবে অনুভুতি কি হতে পারে? আমাদেরও তাই হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছে পরীক্ষা বাতিল , এ জীবন আর রাখব না, আমি রেল লাইনে বডি দেব মাথা দেব না , অনুভুতি এমনটাই ছিল। একের পর এক পরীক্ষা বাতিল হচ্ছে না হয় পিছিয়ে যাচ্ছে। এ কেমন প্রহসন! সেই প্রহসনের রঙ্গমঞ্চে এস এস সি পরীক্ষার্থী। তাদের কষ্ট দেখে হাসিতে ফেটে পড়ছে আমজনতা, এই বুঝি ছিল আমাদের ঘটে! মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন তার প্রহসন- একেই কি বলে সভ্যতা? আমাদের পরীক্ষা দেখলে তিনি হয়ত লিখতেন- একেই কি বলে পরীক্ষা?
১৪ই ফেব্রুয়ারী। দিনটা দেখলেই মনের ভিতর ছ্যাঁত করে ওঠে। এই দিনে ছিল পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা। পরীক্ষার হল এ আমাদের শ্রদ্ধেয় স্বপন স্যার এসে বললেন – Happy valentines day , I love you all. তাহার মিষ্ট বাক্য শুনে প্রথমেই মনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল, আর ভাল হয়ে গিয়েছিল প্রশ্নটা দেখে। বিখ্যাত সিরাজুদ্দউলা নাটকের ডায়ালগ নকল করে বলেছিলাম, তবে কি এই যশোর বোর্ডও আমায় ভালবেসেছিল ? জীববিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গেয়ে উঠেছিলাম- পথহারা পাখি,কি করে বায়োলজিতে এত ছবি আঁকি!
২মার্চ। মনে সেদিন বসন্ত লেগেছে। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েই বুঝলাম, মনটা ভাল হয়ে গেছে, আজ যে পরীক্ষা শেষ, নরকবাসের অবসান। নিজের বিধ্বস্ত হাতদুটোর দিকে তাকালাম। কেমন আছিস রে ব্যাটা? প্রশ্নটা করতেই ম্লান হাসি দেয়ার চেষ্টা করল হাতটা। চারদিক তাকাচ্ছি আর ফোর জির কথা মনে আসছে, যা দেখি নতুন লাগে। সূর্যটাকে আজ বড্ড নতুন লাগছে। সবার ভাগ্যে সুখ বেশিদিন টেকে না, আমাদের ভাগ্যেও টিকবে না। আর কিছুদিন বাদে আবার নামতে হবে যুদ্ধে, জীবনযুদ্ধে। তবু সান্তনা, নরকবাসের অবসান তো হল।

Comments

Popular posts from this blog