গল্পঃ ডার্ক ম্যাজিকঃ দ্যা রিটার্ন অফ দ্যা প্রিস্ট

লেখকঃ আসিফ_মাহমুদ_জীবন

দ্বিতীয় পর্ব

চমকে ওঠার মতই বিষয়, বৃদ্ধ এই রাতে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন, তার বের হওয়া দেখে মনে হচ্ছেনা যে স্রেফ হাঁটতে বের হচ্ছেন।কাঁধে ব্যাকপ্যাকই বলে দিচ্ছে এই গভীর রাতে তার বের হওয়ার কোন উদ্দেশ্য আছে। তার চেয়ে অবাক করা বিষয়, বৃদ্ধের হাতের ছড়ি উধাও। ছড়িতে ভর দিয়ে ছাড়া কখনো উনাকে হাঁটতে দেখেনি শেফা, সেখানে বৃদ্ধ মেরুদণ্ড সটান করে হাঁটছে। বাড়ির বাইরে বের হয়েই বৃদ্ধ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। ওখান থেকে শেফাকে দেখতে পাওয়ার কোন উপায় নেই, তবু শেফা দ্রুত একটা পিলারের আড়ালে চলে গেলো, উত্তেজনায় তার বুকের ধুকধুকানি সে স্পষ্ট শুনতে পারছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃদ্ধ চোখের আড়ালে চলে গেলো, যেদিকে গেলো সেদিকে পাড়ার একমাত্র গোরস্থানটা রয়েছে। শেফা ভয় পাচ্ছে বটে কিন্তু জল কদ্দুর গড়ায় তা দেখার কৌতূহল সামলাতে পারছে না। বৃদ্ধ যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ভোর হবার আর বেশিক্ষণ নেই। বৃদ্ধের বাড়িতে ঢোকামাত্র শেফা নিচে নেমে আসলো, সে বেশ বুঝতে পারছে তার জ্বর এসেছে।

একটা চেয়ারে দড়ি দিয়ে শক্ত করে কেউ শেফাকে বেঁধে রেখেছে, যে কামরায় সে বাঁধা রয়েছে সেটা অন্ধকারে ঢাকা। শেফা প্রাণপণে চোখ খোলা রেখে আশেপাশে দেখতে চাচ্ছে, পারছে না। এমন সময় ক্যাচক্যাচ শব্দে একদিকের দরজা খুলে গেলো, আলোর বিপরীতে থাকায় লোকটার মুখ দেখতে পারছে না শেফা, কিন্তু হাতের ছড়ি দেখে বিন্দুমাত্র বুঝতে সমস্যা অচ্ছে না যে আগন্তুক কে। বৃদ্ধের মুখ এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে তার। এক পা দু পা করে শেফার দিকে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধ, শেফা চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কাছাকাছি এসে ছড়িটা মারার ভঙ্গীতে উপরে তুলল বৃদ্ধ, লক্ষ্য শেফার মাথা। ঠিক সে সময় চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠল শেফা। রাহেলা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, গত চার পাঁচদিন তার মেয়ে জ্বরের প্রকোপে প্রায় সবসময় অজ্ঞান হয়ে ছিল। তিনি বারবার মেয়েকে নিষেধ করেছেন ওই বুড়োর কাছে না যেতে, না জানি তার মেয়ের সাথে কি করেছে ওই বুড়ো!
অনেকটা টলতে টলতে বৃদ্ধের বাড়ির দিকে যাচ্ছে শেফা, জ্বর সেরে গেলেও শরীরটা এখনও বেশ দুর্বল। সপ্তাহে শনিবার একবারই আসে, এই দিনটা নষ্ট করতে চাচ্ছেনা সে , যদিও মাকে বলে এসেছে যে সে রুপাদের বাড়ি যাচ্ছে। বৃদ্ধের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন রাতের কথা আবার মনে পড়ল শেফার, তার সাথে দেখা ভয়ানক দুঃস্বপ্নগুলো। কথাগুলো ভাবতেই হটাত হাসি পেয়ে গেলো শেফার, কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে সে !

বৃদ্ধের আচরণে কোন পরিবর্তন দেখতে পেল না শেফা, বেশ আয়েশ করে তিনি পত্রিকা পড়ছেন। শেফার হাতে এখন মধ্যযুগীয় ডার্ক ম্যাজিশিয়ানদের জীবনী নিয়ে লেখা একটা বই। বইটাতে লেখকের কোন নাম নেই। বইটা আগেও একবার দেখেছিল শেফা, বইয়ের নামটা ইন্টারনেটে সার্চ করেছিল, কিছুই পায়নি। এখানকার অধিকাংশ বইই লেখকের নামবিহীন, ভদ্রলোক এসব বই কিভাবে যোগাড় করেছেন কে জানে! শেফা মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু চোখ বারবার কোণার চেম্বারে চলে যাচ্ছে। বড় বড় করে লেখা ক্লাসিফাইড শব্দটা যেন ব্যাঙ্গ করছে শেফার দিকে তাকিয়ে । বইয়ের চ্যাপ্টারের নামটা পড়ার চেষ্টা করল সে, প্যাঁচানো ইংরেজিতে লেখা,’ দ্যা আনবারন্ট হার্ট‘। চ্যাপ্টারটা যেকোনো বইপ্রেমির জন্যই লোভনীয়। ১৭৯৫ সালে রিচার্ড হেনরি নামক এক খ্রিষ্টান যাজক ডার্ক ম্যাজিসিস্ট এ পরিণত হন।এক মেয়েকে শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দেবার অপরাধে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তার হৃদপিণ্ড পোড়ান যায়নি, পরবর্তীতে সেটাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। একটা জিনিস দেখে অবাক হল শেফা, ভদ্রলোক চ্যাপ্টারের শেষে কিছু একটা লিখেছেন। শেফা পড়ার চেষ্টা করল, পরবর্তীতে বুঝতে পারলো, ভাষাটা ইংরেজি নয়। ঠিক সে সময় একটা গোঙানির শব্দ শোনা গেলো,চমকে পাশের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল শেফা, ভদ্রলোক বুক চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়েছেন।শেফা দৌড়ে বৃদ্ধের কাছে গিয়ে তাকে পাশের ঘরে শুইয়ে দিলো। বৃদ্ধ হাঁসফাঁস করছে দেখে পাঞ্জাবির বোতাম খুলে দিতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠল সে। সারা বুক জুড়ে অসংখ্য ক্ষতের দাগ, ক্ষতগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে আনকোরা নতুন এগুলো। বৃদ্ধ কিছুটা সুস্থির হয়ে উঠেছে, শেফা বুঝতে পারছে তার বেশীক্ষণ এখানে থাকা ঠিক হবে না। ঘড়িতে সময় দেখল সে, প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এখন বাড়িতে না গেলে তার মা যে সন্দেহ করবে তা আর বলে দিতে হয় না। ব্যাগটা নিতে লাইব্রেরিতে গিয়ে কর্নারের চেম্বারটা ফের চোখে পড়ল শেফার। কাজটা করা মোটেই ঠিক হবে না, কিন্তু এরকম সুযোগ আর আসবে না। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানল শেফা, কিন্তু তার জানা ছিল না সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়।

বৃদ্ধ মফিজুল করিম কাউচে বসে আছেন, এই দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তার মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হল । এখন ডাক্তারের কাছে না গেলে আরও বড় অঘটন ঘটতে পারে, কিন্তু মফিজুল করিমের হাতে সে সময় নেই।যা করার আজ রাতেই করতে হবে, অনেক বছরের কাজের ফল আজ পাবেন তিনি। ছড়িতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে লাইব্রেরিতে গেলেন মফিজুল করিম, ছড়িটা সত্যি সত্যি তাকে ব্যবহার করতে হবে এটা কোনোদিন ভাবেন নি তিনি। চেম্বারটা খুলে চমকে গেলেন বৃদ্ধ, বইটা নেই!

শেফা নতমুখে বিছানায় বসে আছে। রাহেলা বেগম কি করে জানি খবর পেয়ে গেছেন যে শেফা রুপাদের বাড়ি যায়নি, সেই নিয়ে পুরো বাড়িতে এতক্ষণ তুলকালাম কাণ্ড চলছিল। পাশের টেবিল থেকে বইটা হাতে নিল শেফা, বইটার উপর তার ঘোর এখনও কাটেনি। শেফা আশাই করেনি যে পুরো চেম্বারে মাত্র একটা বই থাকবে, কি এমন আছে এই বইতে যে সবকটা বই থেকে আলাদা রাখতে হবে! বইটার উপর হাত বোলাল সে, পুরু চামড়া দিয়ে মোড়ানো পুরো বই, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বয়স অনেক। বইয়ের উপরে চামড়া কেটে লেখা-‘ দ্যা ওয়ান হু ডিসারভস ইটারনাল নলেজ’, মানে কি এর? বইচুরির ঘটনা বৃদ্ধের বুঝতে বেশি সময় লাগার কথা না, যখন উনি বুঝবেন তখন উনার সামনে কিভাবে দাঁড়াবে তাই ভাবছে শেফা। শেফার ধারণা মিথ্যা নয়, কিছুক্ষন পরেই কলিং বেলের শব্দ পাওয়া গেলো। রাহেলা বেগম ভীতস্বরে মেয়ের দরজায় উঁকি দিয়ে বললেন, “ বুড়োটা এসেছে।“

শেফা মাথা নিচু করে মফিজুল করিমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মফিজুল করিম নিজেও অস্বস্তিবোধ করছেন।শেফা বইটা বের করে মফিজুল করিমের হাতে ধরিয়ে দিলো, বইটা হাতে নিয়েই তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কি বলবেন তা ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
“ তুমি কি বইটা পড়েছ?” মফিজুল করিম স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু তার কথায় ভয়ের আভাস ঠিকই পাওয়া গেলো। শেফা মাথা নাড়াল, না সে পড়েনি। মফিজুল করিম সস্তির নিশ্বাস ফেললেন, এখন তার যাওয়া উচিত।
“ তুমি আর বই পড়তে এসো না।“ বৃদ্ধের মুখে যদিও এমন কথাই আশা করেছিল শেফা তবু কথাটা শুনে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলল শেফা, জীবনে প্রথম সে এভাবে অপমানিত হল। মফিজুল করিম বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন, তার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে,কিন্তু তার করার কিছু নেই। এক মেয়েকে এই কারণে হারিয়েছেন তিনি, আরেক মেয়েকে হারাতে চাননা।

মধ্যরাত। মোতালেব মিয়া টলতে টলতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। আজকে ব্যবসায় একটু লাভ হয়েছে,লালপানি না খেলে কি হয়! যদিও ঝোঁকে ঝোঁকে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছে, হাঁটতে গিয়ে মাথা চক্কর দিচ্ছে।বাড়ি গেলে সাবেরা কি করবে তাই ভাবছে মোতালেব, নিশ্চিত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলবে, ঘরে নাও ঢুকতে দিতে পারে। সাবেরাকে উদ্দেশ্য করে একটা কুৎসিত গালি দিয়ে মোড়ের গলিটায় ঢুকল মোতালেব, সে জানত না তখনি বাজবে তার জীবনের অশনি সংকেত।
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog