গল্পঃ আতঙ্কের অতীত

 লেখকঃ আসিফ_মাহমুদ_জীবন

শেষ পর্ব


রুবেলের তথাকথিত সর্বনাশটা স্বচক্ষে দেখার জন্য সাইমুমকে টিভির সামনে বসতে হল। আইজিপি আব্দুল করিম প্রেস কনফারেন্স করছেন, সিরিয়াল কিলিং এর রহস্য তিনি উন্মোচন করেছেন। আইজিপি সাহেব ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম পড়ে এসেছেন, টাক মাথায় গুনে গুনে যে তিনটা চুল আছে টা অতি সযত্নে আঁচড়ানো, তাকে সম্ভবত সরিষার তেল মেখে এসেছেন, সাংবাদিকদের ফ্ল্যাশে সেটা বারবার ঝিকমিক করে উঠছে। ক্যামেরার সামনে আইজিপি মহাদয় যখন বললেন আব্দুল করিম অপরাধী তখন সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ একটা গুঞ্জন সৃষ্টি হল, শুধু জামালের মুখ থেকে আইজিপিকে উদ্দেশ্য করে ভয়ঙ্কর একটা গালি শোনা গেলো। টিভির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কথা বলার সুযোগ থাকলে আইজিপি হয়ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন কে তাকে এমন গালি দিলো। জামাল খেয়াল করেনি, তার খেয়াল করা উচিত ছিল, সাইমুম হাসছে।

সাইমুম তার কাজের রুটিন বেঁধে নিয়েছে। বড়শি ফেলা হয়ে গেছে, এখন শুধু টোপ গেলার অপেক্ষা, কিন্তু তার আগে বহু কাজ বাকি, প্রমাণ চায়,নিরেট প্রমাণ। সাইমুম নারায়ণগঞ্জে একটা জরাজীর্ণ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ইতোমধ্যে দুইবার কলিং বেল টেপা হয়ে গেছে, তৃতীয়বার টেপার সাহস পাচ্ছে না সাইমুম।কলিং বেলে সমস্যা আছে, টিপতে গেলেই কারেন্ট শক খেতে হবে। বহুক্ষণ পর একজন প্রৌঢ় মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন।
“ জি কাকে চাই?”
“ জি মা, আপনি মিসেস মনিরুজ্জামান?” মা ডাকার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল, ডাকটা কাজেও দিলো। কারণ মা ডাকার কিছুক্ষণ পরেই সাইমুমকে দেখা গেলো ভদ্রমহিলার বসার ঘরে বসে চা খেতে।
“ আপনার কাছে কিছু জানার ছিল মা, আপনি তো বহুকাল এখানে আছেন।“
“ হ্যাঁ, তাও গত চল্লিশ বছর ধরে তো এই আস্তাকুড়েই...”
“ আচ্ছা, আপনার পাশের বাড়ি করিম চাচারা থাকত না?” ভদ্রমহিলার গল্পের টান থামিয়ে মূল প্রসঙ্গে আসার চেষ্টা করল সাইমুম।
“ চাচা? করিম তোমার চাচা হবে কেন? ও তো তোমার ভায়ের বয়সি। বড় ভাল ছেলে ছিল, আমরা দুজন একা থাকি, প্রায়ই দেখা করতে আসতো। এমনই বা কয়জন করে বল। সেই ছেলে ওই ডাইনির কারণে এখন কি ভোগা ভুগছে?“ ভদ্রমহিলাকে সত্যি বিমর্ষ মনে হল, কিন্তু সাইমুমের মনোযোগ অন্যদিক, ভদ্রমহিলা ডাইনি বললেন কেন! একমাত্র একজনকেই এখানে ডাইনি উপাধি দেয়া যেতে পারে, রেবেকা পারভিন।
“ ডাইনি?” অনেকটা অবাক হবার ভঙ্গীতে বলল সাইমুম। সাইমুমের ফিরতি কথা পেয়ে ঝামটা দিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা,” ডাইনি নয়তো কি! এক নম্বরের বেশ্যা ছিল ওইটা। চরিত্রের ঠিক ছিল না, আমার জনকে পর্যন্ত ইশারা দিয়েছিল! কত্ত বড় সাহস মাগিটার! জালাল ছেলেটাকে কি মারাটাই মারত! সেবার এতমার মারল যে ছেলেটার তো জান যায় যায় অবস্থা, হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিলো। তারপরেই মাগিটাকে খুন করেছে করিম, বেশ করেছে! ওরকম মাগির বেঁচে না থাকাই ভাল।“ মনের সব ঝাল মেটালেন বৃদ্ধা, পরক্ষনে লজ্জা পেয়ে বললেন,” অনেক খারাপ কথা বলেছি, কিছু মনে করোনা বাবা।“ সাইমুম কিছু মনে করেনি, তার মাথায় এখন একটার পর একটা চিন্তা আসছে।
“ রেবেকা জালালকে মেরেছিল! জালাল হসপিটালে থাকা অবস্থায় খুনটা হয়! আচ্ছা মা, খুনের পর জালালকে আর দেখেছেন?”
“ না গো, ছেলেটা কই যে গেলো! তার আর খোঁজ পাইনি।“
সাইমুম মিসেস মনিরুজ্জামানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসলো, নতুন একটা পথ দেখতে পাচ্ছে সে।তার যা জানার সে জেনে ফেলেছে, এখানে নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে আর নেই। ভদ্রমহিলা হাসপাতালের নাম বলেছেন, ডাক্তারের নাম বলতে পারেননি, তার জানার কথাও না।
সাইমুম জামালকে ফোন দিলো। তার একটা নাম দরকার, এই কেসের সবচেয়ে বড় টারনিং পয়েন্ট হবে এই নাম।
“ জামাল, দু ঘণ্টার মধ্যে আমার একটা খবর চাই। আটক করার সময় আব্দুল করিমের কাছে যা যা জব্দ করা হয়েছিলো, বিশেষ করে মানিব্যাগের ভিতরে যা ছিল তার খবর চাই।“
জামাল বেশি উচ্চবাচ্য করল না, হুম বলে কাজে নেমে পড়ল। কেসের সমাপ্তিটা তার নিজের কাছেও ভাল লাগেনি। বিশেষ করে আব্দুল করিমকে এরেস্ট করার সময় তার প্রচণ্ড খারাপ লেগেছে। বেচারা কোনভাবেই খুনি হতে পারে না। সাইমুম যে কিছুর উপর কাজ করছে তা জামাল টের পেয়েছে। জামাল একটা অসাধ্য সাধন করল, দু ঘণ্টা নয়, দেড় ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের মতো একটা দেশে ৬ বছর আগের সিজড ম্যাটারিয়ালস খুঁজে বের করল, সেখানে ডঃ শুভেন্দু কুমারের নাম পাওয়া গেলো।

জামাল আর সাইমুম ডঃ শুভেন্দু চেম্বারে বসে আছে। ভদ্রলোকের মেয়ের আজ জন্মদিন, বের হবার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন।পুলিশের লোক দেখে যার পর নাই বিরক্ত হয়েছেন, গোমড়ামুখ করে বসে আছেন। সাইমুম প্রথমেই অবাক হয়েছিলো দুটো বিষয়ে। আব্দুল করিম সামান্য কেরানি, অসুস্থতায় তার যাওয়া উচিত সদর হাসপাতালে, কিন্তু সে ভাইকে এসেছে এই বিলাসবহুল প্রাইভেট হাসপাতালে! কারণটা কি হতে পারে?!আর দ্বিতীয়ত, ডঃ শুভেন্দু যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ। রেবেকার টর্চারের কারণে যদি জ্বালালকে এখানে আনা হয়, তবে যৌনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কেন!
“ দেখুন, প্রতিদিন প্রায় একশ রোগীর চিকিৎসা করতে হয় আমাকে। সেখানে ৬ বছর আগেকার একটা কেস আমার মনে থাকবে।“
“ হ্যাঁ, আমরা সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু ডক্টর, সে আপনার অধীনে ভর্তি ছিল, তাহলে...”
জামালের কথা শুনে চট করে কথাটা মাথায় আসলো সাইমুমের,” আর্কাইভ? আপনাদের আর্কাইভে তো রেকর্ড থাকার কথা। “
“ জি, সেটা পাবেন। আমি তাহলে আসি?”
“ জি না, আপনি আমাদের সাথে আসুন।“ জামালের কথা শুনে বিরক্ত মুখে আর্কাইভ রুমের দিকে রউনা দিলেন ডঃ শুভেন্দু, তার কপালে আজ সকাল থেকেই শোনো ঘুরছে।
সাইমুম দ্রুত পাতা উলটে যাচ্ছে। এখন তার হাতে ডঃ শুভেন্দুর আন্ডারে যাদের অপারেশন হয়েছে তাদের খাতা।
“ ২৪৫, ২৪৬,২৪৭,২৪৯...২৪৯!” সাইমুম অনেকটা চেঁচিয়েই উঠল, পাশে ডঃ শুভেন্দু দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি চমকে হাতদুয়েক পিছিয়ে গেলেন।“ ২৪৭ আর ২৪৯ এর মধ্যে ২৪৮ কই। দেখুন, কেউ ছিঁড়েছে, আর্কাইভে এসে এমন কাজ কে করবে?”
অবাক ডঃ শুভেন্দুও কম হননি, তার মুখখানা হা হয়ে গেছে, তিনি একবার জামালের দিকে, আরকবার সাইমুমের দিকে তাকাচ্ছেন।
“কেউ একজন ছিঁড়েছে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে।“ জামালের কথা শুনে সাইমুমের হটাত একটা চিন্তা আসলো। এটা যদি জালালের বায়ডাটা হয় তবে ডঃ শুখেন্দু নিশ্চিত তার অপারেশন করেছেন, এটা অপারেশনের রুগিদেরই খাতা। সেক্ষেত্রে আব্দুল করিমকে তার চেনার কথা, রুগির অভিভাবক হিসেবে।
“ জামাল? তোর মোবাইলে করিম সাহেবের কোন ছবি আছে? বের কর তো।“
জামালের মোবাইলে করিম সাহেবের ছবি নিয়ে ডঃ শুখেন্দুর চোখের সামনে ধরল সাইমুম। ডঃ শুখেন্দু কিছুক্ষন ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে থাকলেন, একসময় তার ভ্রূ আসতে আসতে সমতল হয়ে গেলো, তিনি চিনতে পেরেছেন!
“ এ তো করিম কেরানি। হ্যাঁ, এর ভায়ের অপারেশন আমি করেছিলাম।“
“ পাঁচ বছর আগের একজনকে আপনি চিনে ফেললেন?” অনেকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করল সাইমুম, তার মাথায় বুদ্ধিটা এসেছিল বটে, কিন্তু সেটা কাজে দেবে এমনটা ভাবতে পারেনি সে।
“ মনে থাকত না, যদিনা এটা বিশেষ একটা অপারেশন হতো।“
এরপর ডঃ শুখেন্দু যে কাহিনী শোনালেন তাতে জামাল কিছু না বুঝলেও সাইমুম বুঝল, কাহিনী অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। রঙ্গমঞ্চে নতুন নাটকের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে।

সাইমুম যে ঘরে বসে আছে সেটা খুব একটা বড় না, পাড়ার অন্যান্য ঘরগুলোর মতই টিনের ঘর। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, কিন্তু ঘরটায় আলো জ্বালানো হয়নি। সাইমুমের পাশে আরেকজন বসে আছে, জামাল। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে সে মাঝে মাঝেই হাত দিয়ে পিঠ চুলকানোর চেষ্টা করছে। সাইমুম মূর্তির মতো বসে আছে, স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতেই তার এখান বসে থাকা। কিন্তু তার অনুমান ঠিক হবার কথা, প্রত্যেকটা ঘটনা পানির মতো মিলে গেছে। তবু সাইমুমের ভয় হচ্ছে, যদি কোথাও ভুল হয়! রঙ্গমঞ্চে উঠবার আগে অভিনেতা যেমন প্রত্যেকটা বাক্য আরেকবার ঝালিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি প্রত্যেকটা কথা সাজিয়ে নিচ্ছে সাইমুম। দরজাটা একটু একটু ফাঁক হচ্ছে, এক ছায়ামূর্তি প্রবেশ করল,অতি সন্তর্পণে। ফিসফিস আওয়াজ শোনা গেলো,
“ স্যার, এসে গেছে।“
ছায়ামূর্তির কথা শুনে উত্তেজনায় নিজের তাল প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল জামাল। সাইমুম ধীরে ধীরে ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করে ঘর থেকে বের হল। ছায়ামূর্তি একটা ঘরের সামনে এসে থামল। হটাত দেখা গেলো অন্ধকার ফুঁড়ে আরও কয়েকটা ছায়ামূর্তি পুরো বাড়িটাকে ঘেরাও করে ফেলেছে।সাইমুম এগিয়ে গেলো, সশব্দে লাথি মারল দরজায়। সেই লাথির কাছে সামান্য কাঠের দরজা টিকলো না।দরজা ভাঙতেই ভিতরে দেখা গেলো ছুরি হাতে উদ্যত এক ছায়ামূর্তি,তার সামনে হাত পা মুখ বাঁধা নগ্ন এক নারী। সাইমুম আর ছায়ামূর্তি স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যই। চোখের পলকে পিছনের দরজা খুলে দৌড় দিলো ছায়ামূর্তি। আশেপাশে ঘিরে থাকা পুলিশ হটাত এমন আক্রমণ আশা করেনি, তারা ছিটকে পড়ল। ছায়ামূর্তি দৌড়াচ্ছে, তার পিছনে দৌড়াচ্ছে সাইমুম আর জামিল। এভাবে বেশিক্ষণ দৌড়ালে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে খুনি। সাইমুম অতি দ্রুত হাতার ভিতর থেকে কোল্ট .৪৫ রিভালভারটা বের করল। রানিং অবস্থাতেই গুলি করল আততায়ীর দিকে।মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ছায়ামূর্তি, গুলি তার হাতের ডানার নিচে লেগেছে। জোছনা রাত, সাইমুম ধীরে ধীরে আততায়ীর দিকে এগিয়ে গেলো। অনেকটা রঙ্গমঞ্চের অভিনেতাদের মতই বলে উঠল,
“ আসুন পরিচয় করিয়ে দিই। ডাঃ শাহরিয়ার খান, ওরফে আব্দুল জলিল। তাই না?”
জবাবে শাহারিয়ার খান কিছু বললেন না, তার গোঙ্গানি শোনা গেলো। জামাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, বিষয়টা এমন হবে সে ভাবতেই পারেনি। এমনকি এখানে টিম নিয়ে আসার আগেও সাইমুম এ ব্যাপারে একটা কথা পর্যন্ত উচ্চারন করেনি।দুজন হাবিলদার গিয়ে শাহারিয়ার খানকে পাকড়াও করল।
“ ডাঃ শাহারিয়ার খান,উহু, জলিলই বলি। শেষ পর্যন্ত তোমার অহংকারই তোমার পতনের কারণ হল। গল্পের শেষ যখন হচ্ছে, যবনিকা টানা যাক, কি বল?”
জলিলের মুখ দিয়ে হিসহিস জাতীয় শব্দ বের হল, কিন্তু কোন কথা বলল না সে। সাইমুম একটা থানের উপর গিয়ে বসল।
“ জলিল, কেন নারীদেহের প্রতি তোমার এমন বিরুপতা তার সবটাই জানি আমি। তোমার জীবনে কিছু দুঃখজনক ঘটনা আছে, কিন্তু সেই অতীত তোমার ভিতরে অন্যের জন্য আতংক তৈরি করেছে। ২০১১ সাল, গ্রাম থেকে ভাইয়ের বাড়িতে এসে উঠলে তুমি। তুমি কখনো কল্পনা করতে পারনি যে তোমার ভায়ের অজান্তে দিনের পর দিন তোমাকে ধর্ষণ করে যাবে রেবেকা পারভিন, তোমার ভাবি। সেই বয়সে নারীসঙ্গের এমন প্রাপ্তি তোমার মনে নারীদের প্রতি বিরুপ সৃষ্টি করল। তারপর আসলো সেইদিন যেদিন তুমি প্রতিবাদ শুরু করলে, নিজের ধর্ষণের বিরুদ্ধে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তোমার পুরুষাঙ্গে ধারালো অস্ত্রের কোপ বসিয়ে দেয় তোমার ভাবি, তোমাকে গোপনে হাসপাতালে ভর্তি করে করিম, সে আদেও জানত না যে আসল ঘটনা কি। তোমার উপর অপারেশন চালানো হল, ডাক্তারের শত চেষ্টার পরও তুমি নপুংশ হয়ে গেলে। তোমার মনে প্রতিশোধ স্পৃহা আসলো, তুমি খুব বাজে ভাবে প্রতিশোধ নিলে, রেবেকা পারভিনের প্রত্যেকটা স্নায়ুকে কষ্ট দিয়ে তুমি প্রতিশোধ নিলে। কিন্তু তোমার ভাইয়ের কি দোষ ছিল জালাল? তাকে কেন এমনভাবে ফাঁসালে?”
“ আমার ভাই ছিল একটা জানোয়ার, সব জানত ও, তবু কিছু করেনি।“ গোঙাতে গোঙাতে বলল জালাল, কিন্তু কণ্ঠে ঘৃণার তীব্র রেশটা ঠিকই পাওয়া গেল।
‘ আমার ধারণা খুনটা তোমার ভায়ের সামনেই করো তুমি, তাকে বেঁধে রেখে সম্ভবত।“
জালালের উন্মাদের মতো হাসি শোনা গেলো, সে হাসি শুনে কিছুটা শিউরে উঠলেও তা বাইরে প্রকাশ করল না সাইমুম।
‘ তোমার ভাই, প্রচণ্ড মেন্টাল শকে পাগল হয়ে যায়। তুমি একটা সার্টিফিকেট যোগাড় করো, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হও। ৩ বছর আগে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে পি এইচ ডি করতে গিয়েছিলে। রক্তের নেশা তোমাকে পেয়ে বসেছিল, তুমি সেখানে মিসেস মরিসনকে খুন করলে।দেশে ফিরে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলে, কিন্তু রক্তের নেশা তোমাকে ততদিনে পেয়ে বসেছে।তোমার জাল সার্টিফিকেট সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের এক নেতা জেনে ফেলেছিল, আমার ধারণা তুমি তাকেও খুন করেছো। খুন করার জন্য তখন তোমার মন চনমন করছে, তাই তুমি খুন করার জন্য তাই এমন একটা স্তর বেছে নিলে যেখানে দু একজন খুন হলেও কিছু আসে যায় না।কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য অপরাধীদের মতই তোমার একটা বদস্বভাব ছিল, অতিরিক্ত অহংকার। যেদিন তোমার চিঠিসহ পার্সেল পেয়েছি, সেদিনই তোমার অহংকারের পরিমান আঁচ করতে আমার অসুবিধা হয়নি। এই অহংকার দিয়েই তোমাকে ধরার পরিকল্পনা করলাম। আইজিপিকে ভুলভাল বুঝিয়ে তোমার ভাইকে খুনি সাজিয়ে দিলাম। আমি জানতাম, আজ যেহেতু প্রত্যেকটা খবরের কাগজের শিরোনাম ছিল, খুনিকে ধরা হয়েছে, অহংকারের বশে তুমি আজকেই আরেকটা খুন করতে নামবে। যেহেতু আগের পতিতাপল্লীতে পুলিশ গার্ড দিতে পারে তাই তুমি শহরের অন্য প্রান্তের এই পতিতাপল্লীতে এলে, তোমার গল্পের এখানেই সমাপ্তি।“
জালাল মাটির দিকে তাকিয়ে থুতু ফেলল তারপর সাইমুমের দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে বলল,
“ আমার কাহিনীটা খুব চমৎকারভাবে বললে, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। আমি আমার এ পরিণতির কারণ কি?“ সাইমুম জালালের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না, এর উত্তর তার জানা নেই। হাটুগেড়ে বসেই বিদ্যুৎগতিতে বাম হাতা থেকে জলিল ছোট একটা ছুরি বের করে আনলো, সবেগে চালালো নিজের গলায়। সাইমুম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! জলিলের গলায় ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, রাতের অন্ধকারে সে রক্তের রঙ দেখাচ্ছে ঘোর কালো।

আইজিপি আব্দুল করিম ফের প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন, কিভাবে তিনি খুনিকে বোকা বানানোর জন্যে আগের প্রেস কনফারেন্স করেছেন তার তিনি হাসিমুখে জানাচ্ছেন। সাংবাদিকরা মুহুর্মুহু তালি বাজাচ্ছেন, এমন একজন টেকো বুদ্ধিজিবি থাকতে পারে তা তারা জানতেন না। পাশে সাইমুম দাঁড়িয়ে আছে, এ ব্যাপারে তার কোন ক্ষোভ নেই, ডিপার্টমেন্টের সবাই এ ব্যাপারে জানে, এমনকি সাইমুমের প্রমোশনও হয়েছে। সাইমুম এসব নিয়ে ভাবছে না, সাইমুম ভাবছে রাত্রিকে নিয়ে । মেয়েটা রাগ করে ফোন ধরছে না, আজ সারাদিন সে রাত্রির সাথে কাটাবে।

সাইমুমের হাত ধরে রাত্রি বসে আছে, সে অবাক বিস্ময়ে সাইমুমের গল্প শুনছে।
“ জালালটা একটা পশু, কেউ এমনভাবে কাউকে! ছিঃ!”
“ রাত্রি,জালালের প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমি দিতে পারেনি।“
রাত্রি অবাক হল,” মানে কি?”
“ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু ভয়ঙ্কর অতীত থাকে রাত্রি। কিছু কিছু অতীতের আতংক আমরা কখনো ভুলি না, সেই আতংক আমাদের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে। শেষ পর্যন্ত আমরাই হয়ে যায় সেই আতংকের বাহক, আতংক ছড়িয়ে দেই সবখানে। হ্যাঁ, জালাল দোষী। কিন্তু তার দোষী হওয়ার পিছনের দিকটা কজন দেখে।“
রাত্রি অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে, সাইমুমের কেন জানি সন্দেহ হল সে কাঁদছে।
“ রাত্রি, তুমি কি কাঁদছ?” রাত্রি উত্তর দিলো না। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের একটি হল সূর্যের অস্ত যাওয়া। এই দৃশ্য দেখে কি কেউ কি কখনো বিশ্বাস করতে পারবে যে এই দৃশ্যের অপর পিঠে আরেকটা কুৎসিত দিক আছে?
( সমাপ্তি)
( বহু কষ্টে গল্পটা লেখা, পাঠকের কাছে ২-৪ লাইনের মতামত আশা করা কি খুব অন্যায় হবে?)
                         

Comments

Popular posts from this blog