বিষয়ঃ একজন বইপোকার স্বীকারোক্তি

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন 

ছোটবেলাতে খুব ভোরে গানের শব্দে আমার ঘুম ভাঙত। নানা কোথা থেকে যেন একখানা রেডিও কিনে এনেছিলেন। প্রতিদিন সকালে বেতারের সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লাইলা, অরুণ চ্যাটার্জি, সুবীর নন্দীর গানে মনপ্রাণ ভরে থাকত। এক একজনের গলা আমার কাছে অতিপরিচিত’র মতো লাগতো। গানের তখন কিই বা বুঝি, দু আঙুলের আঙ্গুলের বাচ্চা আমি তখন! কিন্তু গানের সুরগুলোর অদৃশ্য এক সুতো ছিলো, সে সুতোয় শিশুবয়সেই আমি আটকা পড়েছিলাম। রেডিওখানা টিউন করে বাজিয়ে মামা রোয়াকে বসে শেভ করতেন আর গুনগুণ করে গান গাইতেন। আমি মাঝে মাঝে চিরুনিটাকে ক্ষুর কল্পনা করে মামার পাশে বসে আমার কচি মুখের কল্পিত দাড়ির বংশ নির্বংশ করতাম। গ্রাম ছেড়ে যবে কংক্রিটের শহর আমার নতুন আবাস হলো,এক অদৃশ্য সুর আমার বুকে খুব বেজেছিলো। শিশু আমি সে সুরের নাম দিতে পারিনি, বেদনার সুরের নাম দিতে নেই, বেদনার সুরের রঙ যে নীল হয়!

কিন্তু কথায় যে আছে, ‘ মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’। শুধু বদলায় না, ক্ষণে ক্ষণে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। আমিও বদলে গেলাম, খুব দ্রুতই বদলে গেলাম। আমার বুকে তখন আর সেই আগের সুর বাজে না, আমার মনে তখন আর আনন্দের বান আসে না। শুকনো জলার ধারে আমি আমার ছেলেমানুষিগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। ঠিক তখনই আমার জীবনে বই এসেছিলো, হরেক রকমের বই, রঙ্গিন সব মলাটে মোড়া বই, জানা অজানা বই। সেসব বই বুকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অনায়াসে কাটানো যায়, বইয়ের মাঝে গভীর নিঃশ্বাসে কাচা কালির গন্ধ পাওয়া যায়। কিছুদিনের মধ্যেই বই আমার কৈশোর জীবনের অর্ধাঙ্গিনীর জায়গাটুকু সজোরে দখল করে নিলো। নব্য পুত্রবধূপ্রাপ্ত মায়ের মনে যেমন সদ্যবিবাহিত পুত্রের বউয়ের আঁচল ধরার স্বভাব প্রকট রুপে ধরা পড়ে আর সেসব বুঝে তিনি ঠুনকো অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকেন, আমার হটাত বইয়ের পাতা ধরে থাকার অভ্যাসে মায়ের মধ্যে তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো । মায়ের গাল ফুলিয়ে থাকাকে আমি অবশ্য তখন একেবারেই কেয়ার করিনি। আমি তখন চাচা চৌধুরির রম্য অভিযানের নিয়মিত পাঠক, ‘তিন গোয়েন্দার’ কিশোর, মুসা, রবিনের অভিযানের নিত্য সহচর, ‘ফেলুদার’ তোপসে আর ‘কাকাবাবুর’ সন্তুর জায়গাটা তো আমারই ছিলো! বইয়ের পাতার প্রতিটি আচড়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম, সে স্বপ্নে নিজেকে প্রধান চরিত্রস্থলে বসিয়ে নায়িকা উদ্ধারে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা ছিলো না। কৈশরের সেই প্রাক্কালে পংখিরাজে চড়ে বসার সময়টুকু ফুরিয়ে গেলেও খলনায়কের পেছনে ধাওয়া করে বেড়ানো গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিলো না। শৈশবের সেই চরকি হাতে মাঠের এ প্রান্ত থেকে অপ্রান্তে তোলপাড় করে বেড়ানো আমি হটাত ভীষণ বন্দুকবাজের রুপ ধরলাম। তালুতে মুঠোয় তখন খেলনা রিভালবার নিয়ে চারদিক আমার পদচারনা। ‘ঠিস-ঠাস’ শব্দে আমার বন্দুক যখন ভিলেনের লক্ষ্যভেদে ব্যস্ত, তখন আমার সামনে এসে দাড়ালো ‘মাসুদ রানা’। কৈশরের সেই বাকে ‘মাসুদ রানা’ কল্পিত ‘আমি’ হটাত রোমান্টিসিজমের স্রোতে ভেসে রইলাম । আমি তখন আর উদ্দেশ্যবিহীন এদিক-ওদিক গোলাগুলি করি না, আমার প্রত্যেক গল্পে তখন একজন নায়িকা থাকে যার মুক্তোঝরা হাসি থাকে, এলোকেশী লাল চুল থাকে, নীলভ চোখের মণিতে যার মনের ভাষা লেখা থাকে। পাশের বাড়ির রুনু খালা আমার সে নায়িকার আবদার দিব্যি পূরণ করতেন। সারা বাড়ি লন্ডভন্ড করে দৌড়ে, রুনুখালার কোলে চড়ে বসলে তার ভুবনমোহিনী হাসি দেখে আর কোনো সন্দেহই থাকত না যে বইয়ের পাতার মাসুদ রানা আমি বিনা আর কেউ নয়।

কয়েক বসন্ত পেরিয়ে যখন পুরোপুরি মাসুদ রানা হয়ে জাকিয়ে বসেছি তখন হিমুর সাথে আমার পরিচয়। রুপা তখন আমার জীবনে আসা প্রথম নারী, যার জন্ম কিনা সাহিত্যের পাতায়। সে সময় হয়ত নিজবোধ এসেছিলো, তাই নিজের একখানা নদী বানিয়ে নিলাম। জলন্বয়ীর তীরে রুপার সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে আমার বিন্দুমাত্র ভাবতে হতো না । কি এক অমোঘ আকর্ষণে আমি বাস্তবতা বিবর্জিত প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। নিত্য দেখা জোছনার চাঁদটুকু হটাত অস্পৃশ্যা হয়ে আমার চোখে ধরা দিলো। আমি তখন নীলভ চোখের চাহনী ছেড়ে কালো কাজলের হাতছানি দেয়া ডাগর ডাগর করে মেলে দেয়া চোখের প্রেমে পড়ে গেলাম। আমার নায়িকা তখন আর রিভালবার নিয়ে আমার পাশে গুলি ছোড়ে না, তখন সে লজ্জাবতী লতার গুচ্ছে সমর্পিত। তার হাতভরা থাকে কাচের লাল চুরি,কলাপাতা রঙের শাড়ির গোলকধাধায় মোড়ানো থাকে তার দেহলতা, কপালে থাকে লাল টিপ, পায়ে থাকে রুপার নুপুর,বাতাসে ভাসে তার নিকষ কালো চুলের ঘ্রাণ, আনন্দে তার চোখের কোণা ভিজে ওঠে । যদিও সেটার বিস্তৃতি শুধু বইয়েরই পাতায়।

কৈশোরের মাঝামাঝি আমি যখন আবেগের বশে মোহিত তখন বাঈজীর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো শ্রীকান্তকে আমার বড্ড কাপুরুষ বলে মনে হতো, তার চেয়ে বরং পার্বতীর নূপুর ঝংকারে উন্মত্ত দেবদাসকে আমার প্রেমের দেবতা বলে মনে হয়েছিলো। সাহিত্যে প্রেমের লীলাখেলাতে রঙে ডুবে থাকা আমি যখন বিভূতিভূষণের ‘অশনি-সংকেত’ এ জঠরটানের নেশায় মত্ত, সমরেশের ‘অনিমেষ’ তখন আমার চোখের রঙিন চশমাটুকু খুলে দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখিয়ে দিলো। আমি দেখলাম “পার্থিব” রঙিন পৃথিবীর অপার্থিব আরেক রঙ, সে রঙ কালো, ঘোর কালো।

কৈশোর যখন বিদায়ের প্রাক্কালে তখন জীবনানন্দের ‘বনলতা সেনের’ ছন্দে আমি মোহিত। চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন আর তার মাঝে বনলতার রুপ খুঁজতে আমি ব্যস্ত। আল মাহমুদের সাথে তার মায়ের সোনার ‘নোলক’ আমি যখন খুজছি তখন সেই অস্পৃশ্যা চাঁদ আমার কাছে সুকান্তের ঝলসানো রুটি হয়ে ধরা দিলো। অগ্নিঝরা কালির মোহে তখন গর্জে উঠতো দেহের প্রতিটি রক্তকণিকা। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’র সোনালি দুঃখের সান্ত্বনা খুঁজতাম নজরুলের ‘সাম্যবাদী’তে। রবীন্দ্রনাথের “যদি আরও কারে ভালোবাসো, যদি আরও ফিরে নাহি আসো, তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখও পাই গো” জীবনের সকল পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ঝেটিয়ে দিলো এক নিমেষে। বেদনার আরেক রঙ চোখের সামনে এসে হাজির হলো, সে রঙের মালিন্যতা ঝাপসা চোখে ঠিক ঠাওর করে ওঠা যায় না । স্বল্পপরিচিত রোমান্টিসিজমের এই অস্পষ্ট,অদেখা ধাপে দিবস-রজনী আমি তার আশায় আশায় রইলাম। সুনীলের কবিতার ‘নীরা’ আমার জীবনে যেন হটাত স্পর্ধা এনে দিলো, তার ওষ্ঠে আঙ্গুল ছুঁইয়ে আমি বেদনার রঙে রঙিন হয়ে বলতে ইচ্ছে করত, “ যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো, আমি বিষপান করে মরে যাব”

আমার কাছে কেন জানি মনে হয় মনের রঙ আছে, সে রঙ ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখনো সে রঙ উজ্জ্বল রঙ্গিন, কখনো বিবর্ণ ম্যাড়মেড়ে। এত-শত রঙ যেন এক ঋতুর পশরা সাজিয়ে আমাদের জীবন জুড়ে জাকিয়ে বসেছে। রঙের বদলে যাওয়াটা হটাত হলেও মনের ঋতুর রংগুলো যেন খুব ধীরে ধীরে বদলায়। শুঁয়োপোকার পর্দা ফুড়ে যেমন হটাত রঙ্গিন ডানা মেলে প্রজাপতি বেরিয়ে আসে, মনের ঋতুগুলোর পরিবর্তন ঠিক তেমনি করে হয়।
জীবনে বহু বাক আমার এসেছে, সেসব বাকে কখনো প্রিয়জনকে হারিয়েছি, কখনো নিজেকে। কিন্তু বই আমাকে হারায়নি। কেউ যদি আমায় হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে, মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছা কি, আমি নির্দ্বিধায় চোখ বুজে বলতে পারব, আমি মৃত্যুর আগে এক লক্ষ বই পড়তে চাই।
                                     

Comments

Popular posts from this blog