খোলাচিঠি 

আসিফ মাহমুদ জীবন

প্রিয় জননী,
মায়েরা কেন জানি নিজের সন্তানের ব্যাপারে খুব স্বার্থপর হয়, নিজের সন্তান অন্য কাউকে আর্দ্র কন্ঠে মা বলে ডাকবে এটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। তোমায় প্রথম যেদিন মা বলে ডেকেছিলাম সেদিন কিন্তু আমার জন্মদাত্রী বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেননি। হয়ত বুঝেছিল যে আমার প্রতি তোমারও অধিকারের পাল্লা সমান, তুমি যে জন্মভূমি!

জানো মা? তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সবুজ পাড়ের লাল বৃত্তে, তখন আমি বেশ ছোট্ট, এক্কেবারে এট্টুখানি। ছোট্ট সে আমি তোমায় ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অবাক চোখে সেদিন এই মাঠ-ঘাট, তেপান্তর, ফানুসে মেঘ আর ছড়িয়ে থাকা সবুজের মাঝে লাল অরুণ আমি নতুন করে দেখতে শিখেছিলাম। সেদিনই প্রথম দরাজ কন্ঠে বলেছিলাম, আমার সোনায় মোড়ানো মা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

মা আমি গল্প শুনেছি, ৪৭ বছরের পুরোনো গল্প, বারুদের পোড়া গন্ধের গল্প, শকুনে ছিড়ে খাওয়া লাশের গল্প, সন্তান হারানো মায়ের অসহায় আর্তনাদের গল্প, আর... হায়নার গল্প। বইয়ের পাতায় সে গল্পর বীভৎসতায় আমার ব্যাকুলতা দেখার মতো ছিলো। ঠিক তার পরমুহূর্তে রাইফেল নিয়ে গর্জে ওঠা তোমার সূর্যসন্তানদের বীরত্ব আমার চোখে নতুন আশা দিয়েছে, দিয়েছে জেগে ওঠার শক্তি।

মাগো, আজ ৪৭ বছর পরও বাতাসে রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়, অলিতে গলিতে পাওয়া যায় তোমার নাম না জানা সন্তানের লাশ। জানো? আজও মায়ের বুক খালি হয়, আজও আমার বোন ধর্ষিত হয়। আজ ৪৭ বছর পর ৩০ লাখ সেই সূর্যসন্তানদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহের পাহাড় জমে।

মাগো, তোমার সেই ছেলেটাকে ওরা পিটিয়ে মেরেছিলো, হায়নার মতো ছিড়ে খেয়েছিলো প্রতিটি অস্থি। সেদিন আবরারের মায়ের কান্না শুনে ৭১’ এ খালি হয়ে যাওয়া মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ খুব মনে পড়ছিল। ছেলেটাকে ওরা মেরেছিল কেন জানো? তোমায় বড্ড ভালবাসত যে!

৪৭ বছরের পোড়া গন্ধের রেশ আজও যায়নি মা, নুসরাতকে ওরা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো, একটু একটু করে দগ্ধ করেছিলো দেহের প্রতিটি কোষ। কেন জানো? তোমার জন্য প্রতিবাদী হয়েছিলো যে!
হায়নাদের ক্ষুধা আজও মেটেনি মা, আমার বোন তনুকে ওরা সেই লালসার স্বীকার বানিয়েছিল। ঘন অন্ধকারে তোমার বুকেই মাথা গুঁজেছিল তার রক্তাক্ত দেহ। আমার বোনের আত্মা আজও কেঁদে ফিরে বেড়ায় মা। বছর গড়িয়ে গেল,বিচার সে পায়নি, পাবে কি?

জানো মা? তকীকে ওরা রেহাই দেয়নি। লাল টুকটুকে আপেলরঙা সেই ছেলেটা, ছোটবেলায় তোমার বুকেই ছিলো যার হুটোপুটি, তার দেহকেও আবিরের রঙে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিল ওরা।

মা, তুমি কল্পনা করতে পারবে কিভাবে সাগর-রুনিকে ধীরে ধীরে মেরেছিলো? তাদের ছোট্ট শিশুর আর্তনাদ সেদিন কেউ শোনেনি, তুমি শুনেছিলে সেই অবলার মিনতি?


৪৭ টা বছর হয়ে গেছে মা, বইয়ের পাতায় পড়া ৭১ এর সেই বিভীষিকা আজ চোখের সামনে। আজও তোমায় সোনায় মোড়াতে পারিনি মা। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সুরেলা কন্ঠে বলি “আমার সোনার বাংলা” তখন নিজেকে খুব মিথ্যাবাদী মনে হয়। ধমনীতে শৌর্য-বীর্যের সেই বাঙালির রক্ত, তবু আজ অন্যায়ের সামনে আমরা চুপ করে থাকি মা। আজ আমাদের রক্তে আর সেই তেজ নেই, অন্যায়ের উল্টোপিঠে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মাদকতা নেই। আজ কেন জানি সবাই স্বার্থপরের মতো তোমায় ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে । তবে কি একাত্তরের সেই হায়নার দল আজও বিদায় নেয়নি! নাকি তাদের সুপ্ত বীজে আমরাই হয়ে উঠছি হায়না?
তবু তুমি নিশ্চুপ কেন মা? সন্তানের ভুলে যে তাকে শাসন করতে হয় সেটুকু কি তুমি ভুলে গেছ? আজ তোমার প্রসন্ন মুখে হাসি নেই কেন মা? তোমার গাঢ় লাল হয়ে যাওয়া বৃত্তের সবুজ আজ এতো মলিন কেন? তোমার মাটিতে আজ এতো রক্তের গন্ধ কেন?
আমি ভালো নেই মা, আমরা ভালো নেই। আজও প্রতিরাতে তোমায় স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি তোমার কাছে করা প্রতিশ্রুতি পুরণের। হয়ত কোনো এক অরুণরাঙ্গা ভোরে কাঁচা সোনার রঙে রাঙ্গিয়ে দিয়ে তোমার সামনে মাথা উঁচু করে বলব, “আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”
ইতি
তোমার এক ডানপিটে সন্তান।
                     

Comments

Popular posts from this blog