গল্পঃ ডার্ক ম্যাজিকঃ দ্যা রিটার্ন অফ দ্যা প্রিস্ট

লেখকঃআসিফ_মাহমুদ_জীবন

প্রথম পর্ব

সময়টা ১৭৯৫, নভেম্বর মাস।আমেরিকার ফিলাডপিয়া অঙ্গরাজ্যে তখন প্রচণ্ড শীত, ক্রমাগত তুষারপাত হচ্ছে, রাস্তার ধারের গ্যাসবাতি গুলো প্রায় নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। প্রচণ্ড শীতকে অগ্রাহ্য করে শহরের কেন্দ্রে জড় হয়েছে উত্তেজিত জনগণ, তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই জ্বলন্ত মশাল। চারদিকের হট্টগোল দেখে ‘ব্যাটল অব পিস’ ম্যুরালের পাদদেশে উঠে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালেন কাউন্ট সুলিভান। মুহূর্তের মধ্যে সব হট্টগোল থেমে গেলো, সবার চোখ এখন কাউন্টের দিকে।
“ মাই ডিয়ার লেডিস এন্ড জেন্টস,আপনার সবাই হয়ত বিষয়টা জানেন। তবুও আরেকবার সবাইকে এটা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের এককালে সকলের শ্রদ্ধেয় প্রিস্ট রিচার্ড একজন ছদ্মবেশী প্রতারক। চার্চে ঈশ্বরের দোহায় দিয়ে আমাদের চোখের আড়ালে তিনি শয়তানের উপাসনা করেছেন। ছিঃ,ভাবতেও লজ্জা হয় যে এমন একজন মানুষের কাছ থেকে আমরা হলি ওয়াটার নিয়ে পবিত্র হবার চেষ্টা করেছি!”
উপস্থিত জনগনের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেলো। কাউন্ট সুলিভান সেসব পাত্তা না দিয়ে ফের শুরু করলেন,
“কয়েকদিন আগে আমাদের শহরের একটা ছোট্ট সুন্দর মেয়ে লিসাবেথ হারিয়ে গেলো। আজ আমরা জানতে পেরেছি সেই নিখোঁজ হবার কারণ এই রিচার্ড। শয়তানের কাছে বলি দেয়া হয়েছে আমাদের ছোট্ট লিসাবেথ কে! আর সেটা করেছে ওই শয়তানপূজক ভণ্ড রিচার্ড!”
উপস্থিত জনগনের মধ্যে এবার একটা বড় আকারের শোরগোলের শব্দ পাওয়া গেলো। সেই শোরগোলের শব্দ ছাপিয়ে মিসেস মরিসনের কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো,মেয়ে লিসাবেথের মৃত্যু সংবাদ তিনি মেনে নিতে পারছেন না কোনমতেই।
“ তাই আসুন, ওই রিচার্ডকে আজ আমরা নিজহাতে শাস্তি দেব, জীবন্ত পুরিয়ে মারব ওকে! ওই চার্চ আমরা গুড়িয়ে দেব, ওটা এখন আর ঈশ্বরের ঘর নয়, ওটা শয়তানের ঘর। এই চার্চ গুড়িয়ে দিয়ে ঈশ্বরের জন্য নতুন একটা চার্চ বানাব আমরা, যেখানে রিচার্ডের মতো শয়তানের কোন স্থান হবেনা!”
আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ল না,সবাই মশাল হাতে ছুটল শহরের প্রান্তে থাকা চার্চের দিকে। কয়েকজন যুবক গিয়ে ভেঙে ফেলল চার্চের দরজা। ভিতরে ঢুকে পড়ল ক্ষিপ্ত মানুষেরা, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের শিখা।
প্রিস্ট রিচার্ড চার্চের দোতলায় দ্রুত নিজেকে প্রস্তুত করছে, এখন অবশ্য তাকে আর প্রিস্ট বলা চলে না, তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। বইটাকে নিয়ে দ্রুত সকল নিয়মাবলী পালন করছে সে, তার সময় এ যুগে ফুরিয়েছে। তার প্রভু লুসিফারের সহায়তায় তিনি আবার ফিরে আসবেন নতুন কোন যুগে। চার্চে আগুন দিয়ে বাইরে মিছিল করছে উন্মত্ত জনতা, আগুন দোতলা পর্যন্ত উঠে এসেছে।প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে দোতলার জানালা দিয়ে ছিটকে পড়লেন রিচার্ড।
হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার পাশ ধরে আগাচ্ছে রিচার্ড।ডান দিকের পাজরে হাড় ভেঙে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তবু বইটা সাথে নিয়ে দাতে দাঁত চেপে সামনে আগাচ্ছে সে। প্রভু লুসিফারের আরও একটা কাজ করা বাকি রয়ে গেছে।ভোরের আলো ফোঁটার আগেই কাজটা করতে হবে,নতুবা এত দিনের সাধনা সব বিফলে যাবে।পোস্ট অফিসের সামনের থানে কোনোমতে হেলান দিয়ে বসল সে। বইটা বের করল, বইটা ইতোমধ্যে প্যাকেট করা হয়েছে, উপরে ভারতবর্ষের কোন এক স্থানের দুর্বোধ্য এক ঠিকানা।প্রভু লুসিফারের নির্দেশ মতো কাজটা করছে সে, যদিও জানে না এটা করার কারণটা কি। বইটা বক্সে রেখে হাসি ফুটে উঠল রিচার্ডের মুখে, প্রভু লুসিফার খুশি হয়েছেন। তার কাজ শেষ, না না, আর একটা কাজ বাকি, আত্মহুতি!

রিচার্ড কে ধরা হয়েছে, শহরের মাঝখানে এর মধ্যেই মানুষের ঢল নেমেছে। রিচার্ড পাগলের মতো হাসছে, তার হাসি দেখে কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। শুধুমাত্র কয়েকজন সাহসি তরুন দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে তাকে। কাউন্ট সুলিভান ধীর পায়ে রিচার্ডের সামনে আসলেন, রিচার্ড তখনও পাগলের মতো হেসে চলেছে।
“ ঈশ্বরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু!!!” সুলভিনের কথা শুনে রিচার্ডের মনে কোন ভাবান্তর না হলেও উপস্থিত জনতার মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেলো।
“আর প্রভু লুসিফারের দাসত্ব মানে অমরত্ব” রিচার্ডের কথা শুনে আশেপাশে কয়েকজন ভয়ে পিছিয়ে গেল, খোদ কাউন্ট সুলিভানও আতংকিত হয়ে পড়লেন।
“ একে এক্ষুনি অগ্নিকান্ডে নিক্ষেপ করা হোক।“ চেঁচিয়ে বললেন সুলিভান,” শয়তান পূজারির কোন স্থান এই পবিত্র শহরে নেই।“
কাউন্টের মুখে এই কথা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল যেন আশেপাশের মানুষ। টেনে টেনে-হিচড়ে তাকে নিয়ে যাওয়া অগ্নিকুন্ডুর পাশে। সবার সামনে রিচার্ডকে ছুড়ে ফেলা হল অগ্নিকুণ্ডের ভিতরে। একটা গগনবিদারী চিৎকার শোনা গেলো, আর তার সাথে শোনা গেলো রিচার্ডের একটা মর্মভেদী কথা,
“দ্যা সোল শ্যাল রাইজ এগেইন”

২০১৯ সাল, জুন মাস
“ তোমার এখন বাড়ি যাওয়া উচিত শেফা।“বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা শুনে শেফা বিরক্ত হলেও হাসিমুখে বৃদ্ধের দিকে তাকাল, যে হাসির অর্থ হতে পারে-আর পাঁচ মিনিট সময় দেয়া যাবেনা?
শেফা বেশ রূপবতী, রূপবতীদের সুবিধা হচ্ছে এরা যেকোনো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবার আগেই হেসে পরিস্থিতি সামলে আনতে পারে। কিন্তু শেফার হাসিতে বৃদ্ধের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না, তিনি লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন। শেফা এ ইঙ্গিতটা চেনে, তিনি লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করবেন, শেফাকে এক্ষুনি বের হয়ে যেতে হবে।শেফা বিরক্ত মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসলো,মধ্যযুগীয় রাজবংশ নিয়ে একটা দারুন বই পরছিল সে, হটাত এমন একটা বাঁধা। আবার সামনের শনিবার আসতে পারবে সে, ইচ্ছে করেছে তো পরের দিনই আসে, কিন্তু পারবে না। এটা কোন পাবলিক লাইব্রেরি নয়।

শেফাদের পাড়ায় হটাত করে এই বৃদ্ধের আবির্ভাব হল। তিনি বাড়ির বাইরে প্রায় বেরই হননা, পাড়ার কারো সাথে কথা হয়েছে এমনটাও শোনা যায়নি। পাড়ার মধ্যে এমন গুজব রটে গেলো যে ভদ্রলোক নির্ঘাত জিন সাধনা করেন, না হলে এমন ঢাকাচুপির মানেটা কি! শেফা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল এরকম গুজবকে তার মা বাবা পর্যন্ত মহাসমারোহে প্রচার করছেন। শেষ পর্যন্ত অনেকটা কৌতূহলের বশেই ভদ্রলোকের দরজায় কড়া নাড়তে হয়েছিলো, তাতে আরেকটা আশ্চর্যের বিষয় বের হয়ে এসেছিল। ভদ্রলোক যথেষ্ট অমায়িক আর সামাজিক। শেফাকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন। ভদ্রলোকের বাড়ির ছবিগুলো দেখেই শেফা বুঝেছিল ভদ্রলোক বিপত্নীক, সন্তানসন্ততি নেই। তার চেয়ে অবাক করা বিষয় অপেক্ষা করছিল উত্তরকোণার হলঘরটাতে,ভদ্রলোক পুরো হলঘরটা লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছেন। সে লাইব্রেরিতে আবার বিচিত্র রকমের বই, শেফা কয়েকটা বইয়ের নাম পড়ার চেষ্টা করেছিল, সবই অপরিচিত। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা শেফার, এমন একটা সুযোগ সে কোনমতেই হাতছাড়া করতে চায়নি। বৃদ্ধের কাছে প্রতি শনিবার এসে বই পড়ার অনুমতি চেয়ে নিয়েছিল। শেফা যখন ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো তখন তার মনে পড়ল, ভদ্রলোকের নামটাই জানা হয়নি। যদিও একটা স্মারকে মফিজুল করিম নামটা দেখেছিল সে, উনি সম্ভবত প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে চাকরি করতেন। এ পর্যন্ত মোট চারবার লাইব্রেরিতে গিয়েছে সে, একবারও নামটা জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না। আজ লাইব্রেরিতে একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছে শেফা, লাইব্রেরির এক অংশে প্লাইউড দিয়ে একটা প্রাইভেট কর্নার বানিয়ে নিয়েছেন বৃদ্ধ, এটা আগে ছিল না। ওই কর্নারে বই আছে নিশ্চিত, কিন্তু প্লাইউডে বড় বড় করে ‘ক্লাসিফাইড’ শব্দটা টা জানতে দিচ্ছে না। শেফার দু একবার যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু যতক্ষণ শেফা বই পড়ে, ভদ্রলোক কঠিন মুখ করে পাশে বসে পত্রিকা পড়েন। তার সামনেই চোরের মতো ওই চেম্বারে ঢোকা অভদ্রতা হবে, তিনি তো আর এমনি এমনি শব্দটা লেখেননি।

শেফা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে।আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। ঘুমানোর আগে কফি খাওয়াটাই ভুল হয়েছে, আবার কফি খেতে ইচ্ছে করছে। কফি বানাতে উঠেই শেফা লক্ষ্য করল আজ খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে, জোছনায় চারদিক ছেয়ে গেছে। সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল সে, যতক্ষণ না ঘুম আসছে ততক্ষণ ছাদে বসে কফি খাবে সে। ছাদে গিয়েই শেফার মনটা ভাল হয়ে গেলো, সত্যি অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজকে। এখান থেকে বৃদ্ধের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল শেফা।
( চলবে)                       
                                 

Comments

Popular posts from this blog