কলেজে প্রথম দিন ( বাস্তব অভিজ্ঞতা )

লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শীঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

বিশাল গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে, স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কবে কবে যে কলেজের গেটে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেরাও টের পাইনি। আজ এই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি বেশ বড় হয়ে গেছি ( আমি কিন্তু আগের মতোই ছোটখাটো, গোলগাল, তিন বেলা ভাত গেলা বাঙালিই আছি)। দুরুদুরু বক্ষে ভিতরে প্রবেশ করলাম, চারদিকে মহিলা আর আমাদের মতো বাচ্চা ছেলেদের ছড়াছড়ি। আমরা কজন কলেজ চত্বরের এককোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝেই কতিপয় মহিলা আমাদের পায়ের কাছে পানের পিক থেকে শুরু করে আটার বাক্স ছুড়ে মারছেন আর আমরা সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যাচ্ছি। তারপর শুরু হল অ্যাসেম্বলি। বি এন সি সি এর একজন কমান্ড দেয়া শুরু করলেন, তিনি মার্চ করতে করতে অধ্যক্ষ মহোদয়ের দু হাত সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিকট আকারে স্যার বলে চিৎকার দিতেই অধ্যক্ষ মহোদয় বুকের বা দিক চেপে ধরে চোখ মুখ উলটে গো গো শব্দ করতে লাগলেন। এমন মহা কেলেংকারিতে চারদিক হৈ হৈ করে লোকজন ছুটে আসার আগেই কমান্ডার মদন দ্বিতীয়বারের মতো স্যার বলে চিৎকার দিতেই ভেল্কিবাজির মতো কাজ হল। অধ্যক্ষ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তার উল্টানো চোখমুখ সোজা হয়ে গেলো। এতদিন বাংলা সিনেমাতেই মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে স্মৃতি ফেরাতে দেখেছি, হুংকারেও যে কাজ হয় এটা জানা ছিল না। তারপর ক্লাসরুমে ঢুকেই দেখি মহিলারা সামনের পুরো জায়গাটুকু নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে। কিছু জায়গা ফাকা ছিল, সেদিকে পা বাড়াতেই কয়েকজন মহিলা কেনাইন টিথ বের করে যেভাবে দাঁত খিঁচুনি দিলো, আমাদের মতো বাচ্চাদের দৌড়ে পিছন দিকে পালিয়ে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্লাস শুরু হল, আমরা স্যার আর বোর্ড থেকে কমপক্ষে আধামাইল দূরে।হতচ্ছাড়া স্পিকারটা বোধহয় মেড ইন চায়না, এ কারণেই বেশি দিন যায়না। সামনে থেকে স্যারের কথা শোনা না গেলেও কিছু ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, পরে বুঝতে পারলাম ওটা মহিলাদের হাসির আওয়াজ। আমাদেরকে প্রথম ক্লাসে ফিজিক্স পড়ানো হচ্ছিল, সম্ভবত ভেক্টর। যেহেতু আমরা স্যারের কথা শুনতে পারছিলাম না তাই আমরা কল্পনা করে নিলাম তিনি কি বলছেন।

কল্পনাঃ
“বন্দুরা, আমি এখন তুমাদের দেকাব কি করে সোজা লাইন আকাতে হয়। এই আমার হাতে একটা কলম, এই দুই আঙুলের মাঝখানে কলমটা নিলাম, এবার আমি টান দেব।“ এবার বোর্ডে গিয়ে তিনি কলমটা ঠেকিয়েই জোরে টান দিলেন।“ আঁকা হয়ে গেলো সোজা লাইন, ক্লাস ডিসমিস।“

স্যারের অভিনব ক্লাসে অংশগ্রহণ করে আমরা মিনিট দুয়েক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হা করে বসে রইলাম, পুরোপুরি সামলে ওঠার আগেই আসলেন বোটানি ম্যাডাম।তিনি এসেই মাইক্রোফোন নিয়ে যে কথাটা বললেন সেটা হল, ‘ ছেলেরা পিছনে কথা বোলো না ‘। ম্যাডাম প্রতি মিনিটে দুবার করে এই কথাটা বলছেন, ছেলেরা পিছনে কথা বোলো না। এমন অন্যায় কথা শুনে মাইক্রোফোনও নিরব প্রতিবাদ জানিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো, যদিও ম্যাডামের রাম থাবড়া খেয়ে কয়েক মুহূর্তে সে ও সোজা হয়ে গেলো। ক্লাস চলছে, ম্যাডামের ঠিক পাশে এক মহিলা বক্তৃতা দেবার ভঙ্গীতে বলছেন,’ মানি না, মানবো না’। তিনি আসলে কি মানেন না আমরা বুঝতে না পারলেও তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন মহিলা সম্মিলিত কণ্ঠে চেঁচাতে লাগলেন, ‘মানি না, মানবো না‘। ম্যাডাম তাদের দিকে স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাইক্রোফোন মুখের কাছে এনে বললেন, “ ছেলেরা, কথা বোলো না।“

পরবর্তীতে আমাদের ইংরেজি ক্লাস, আমি ভয়ে কাঁপছি। সারাজীবন আমি ইংরেজিতে কাঁচা, একেবারে মহা কাঁচা। স্যার এসে উল্টোপাল্টা কিছু ধরবেন কিনা ভয়ে আছি। স্যার আসলেন, বক্তৃতা দেয়া শুরু করলেন এবং ৫ মিনিট পর আমরা নিজেদেরকে সমাজ ক্লাসে আবিস্কার করলাম।

রোল ডাকার পর্ব চলছে, আমরা ইয়েস স্যার, প্রেজেন্ট স্যারের সাথে সাথে আছি স্যার, গন্ধ স্যার নানাভাবে প্রেজেন্ট দিচ্ছি। আমাদের এক কবি দাদা ইতোমধ্যে প্রেমে পড়ে ক্লাসেই কবিতা লেখা শুরু করেছেন। তার খাতা নিয়ে দেখলাম সেখানে সদ্য রচিত কবিতাখানা লেখা আছে-
‘কলেজে অনেক নারী এসেছে
সবাই আমার প্রেমে ফেঁসেছে
কিভাবে বুঝলাম?
কারণ সবাই আমাকে দেখে ঝেড়ে কেশেছে’
তার এই সুন্দর কবিতা দেখে আমার চোখে কাশতে কাশতে জল এসে গেলো। মেরুদণ্ড ‘ছেড়ে দে আব্বা কেন্দে বাঁচি’ বলে চেঁচাচ্ছে, টানা ৪ ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকলে এমনই হওয়ার কথা। ছুটি দেয়ামাত্রই আমরা দ্রুত কলেজ থেকে বের হয়ে আসলাম, আগামি দু বছর কলেজ যে আমাদের জীবনে আতংক হয়েই থাকবে তা আমি একদিনে বুঝে গেছি। তবু আমরা বাচ্চা ছেলেরা সব সামলে নিতে পারব, কারণ আমরা সবাই বয়েজ স্কুলের থুক্কু কেসি কলেজের ছাত্র।
            

Comments

Popular posts from this blog