গলপঃনরকের ফুল

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

শেষ পর্ব

রাতে শুয়ে আছে লাল বানু। এক হাত জোছনার ক্ষুদ্র দেহের উপর উঠানো। বাইরের জোছনা যেন চুইয়ে চুইয়ে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকছে। লাল বানুর চোখ চলে যায় মফিজের দিকে। এ কি! এ তো মফিজ নয়, আনিস! হতভম্ব হয়ে যায় লাল বানু, চোখ রগড়ে উঠে বসে। নাহ, মফিজ ই শুয়ে আছে। নীল জোছনার দৃষ্টিবিভ্রম , কিন্তু লাল বানুর কাছে কেন জানি দৃষ্টিবিভ্রমটাই ভাল মনে হয়। মনের গভীরে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেই শূন্যতা বের হয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস হয়ে। জোছনায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে জোছনাকে, ঠিক যেন একটা ফুল, একটা নিষ্পাপ ফুল।

বাড়িতে আনিসের আনাগোনা বেড়েছে। মফিজ বাইরে গেলেই বাড়িতে উপস্থিত হয় আনিস। বাইরে বাইরে বিরক্তি দেখালেও মনে মনে কেন জানি খুশি হয় লাল বানু। আনিস যখন চলে যায়, কেন জানি অস্থির লাগে তার, যেন দুনিয়াটা মুহূর্তের জন্য কাছে এসে ফের সরে যাচ্ছে। আনিসের আসার পথের দিকে তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকে লাল বানু, সে চাহনিতে কোন ক্লান্তি নেই, আছে শুধু মুমূর্ষু এক আশা। সেদিন আনিসের সাথে গল্প করছিল লাল বানু।
“ আপনে রোজ রোজ এইহানে আইয়েন না, বেবাক মানসে বেবাক কথা কয়। “

মুখে মুড়ি নিয়ে পাটালিতে কামড় দিতে দিতে লাল বানুকে আড়চোখে দেখে নেই আনিস। প্রতিবার ই এক কথা বলে লাল বানু কিন্তু তার পরের দিন ঠিক আবার আনিসের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনে।
“ আচ্ছা, কাইল থেইক্যা আর আইমু না।“ কিছুটা আশাহত হয়েই যেন আনিস উত্তর দেয়।
আনিসের কথা শুনে চমকে ওঠে লাল বানু,কি বলে ফেলল সে! মাথা নিচু করে থাকে সে। আনিস কোন কথা না বলেই হাঁটা দেয়। লাল বানু আর পারে না-
“ আনিস ভাই!”
আনিস কিছুটা অবাক হয়েই পিছনে তাকায়।
“ আবার আইয়েন।“
লাল বানু ভিতরে চলে যায়। আনিসের মুখে এক চিলতে হাসি দেখা যায়, আজ কেন জানি তার মন ভাল হয়ে গেছে।
“ ছাওয়াল ডা কেডা রে লাল?” ফিরোজার মার প্রশ্নে চমকে ওঠে লাল বানু।
“ কিরে কতা কস না কিল ল্যাইগা? ছাওয়াল ডা কেডা? হেইদিন থেইকা দেখতাছি রোজ আহে, কিডা ও ব্যাডা? “
লাল বানু জবাব দিতে পারেনা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরোজার মার বুঝতে বাকি থাকে না জল কতদূর গড়িয়েছে। লাল বানুর বুক ধক ধক করছে, হৃদপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা ছেড়ে মুক্তি পেতে চাচ্ছে, অজানা আশংকায় তার মন ভরে গেছে। ছোটদের কে বড়রা যেমন মিথ্যা সান্ত্বনা দেয়, ফিরোজার মা অনেকটা তেমনভাবেই লাল বানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
“ যাই করিস ভাইব্যা চিন্তা কইরা করিস।“ লাল বানু আবেগে কাঁপতে থাকে, সে আবেগ ঠিক কান্না নয়, আবার চাপা ভালোবাসাও না ।

ঘরের ভিতরে চলে আসে লাল বানু। আজ খুব সাজবে সে। আনিসের দেয়া লাল পেড়ে শাড়িখানা পরে, আয়তলোচন চোখে যত্ন কাজল দেয়, কপালে বেশ হিসাব করে একখানা লাল টিপ দেয়। আয়নাতে নিজেকে বারবার দেখে লাল বানু। আনিসের কথা মনে পড়তেই নিজের লাল হয়ে যাওয়া কপোল তার চোখ এড়ায় না।
“ আনিস হুনলাম তুমার বউর লগে ইটিসপিটিস করে। মাইয়া মানসের পাঙ্খা গজাইলে পাঙ্খা কাটি দিতি হয় ইডা শেখ নাই মিয়া!” খয়রি হয়ে যাওয়া দাঁত দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে একগাল হেসে মফিজকে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো বলে মনসুর মিয়া। মনসুরের কথা শুনে মফিজ তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে, তাইতো! এ কথা তো তার মাথায় আসে নি! এ সুযোগ তো ছাড়া যায় না। বাড়ির দিকে রউনা হয় মফিজ, তার রক্তচক্ষুই বলে দেয় তার বাড়ির দিকে হটাত আগমনের হেতু কি।
লাল বানু আজ তার নামের সার্থকতা রাখতে খুব সেজেছিল। এখনো সে সেজে আছে, তবে লাল রক্তে। বাড়ি এসেই লাল বানুর শাড়ি দেখে হাতেনাতে প্রমাণ পায় মফিজ। রান্না ঘর থেকে একটা বড় সাইজের চেলাকাঠ এনে মারতে থাকে লাল বানুকে। মনুষ্যত্বের বল্গা ছিঁড়ে পাশবিকতায় নিজেকে সঁপে দেয় সে। শুভ্র শাড়ি লাল হয়ে যায় রক্তে, লাল পাড়ের সাথে মিশে ঠিক বিয়ের দিনের শাড়ির মত দেখাতে থাকে। জোছনা দাওয়ার উপর শুয়ে ছিল। সে কান্না শুরু করতেই লাঠিখানা নিয়ে জোছনার দিকে আগায় মফিজ। আধো চেতনাতেও লাল বানুর বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না কি ঘটতে চলেছে। ছুটে গিয়ে নিজের ফুলকে আঁকড়ে ধরে আড়াল করে সে।তার পিঠের উপর সর্বশক্তি দিয়ে মফিজ লাঠির বাড়ি মারতে থাকে। সে ঘটনার সাক্ষী একজন দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু নিরবে চোখের অশ্রু আঁচল দিয়ে মোছা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।

নীল জোছনার নিচে একটা দেহ পড়ে আছে, সে দেহে প্রাণ থেকেও নেই। মুহূর্তের জন্য দেহটা নড়ে উঠল। জোছনাকে জড়িয়ে ধরে নিথর দেহের লাল বানু নিরবে অশ্রু বহিয়ে চলেছে। মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে মনটাকে শান্ত করতে চাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াসে ক্লান্ত সে। রক্তের লালিমায় ভরা শাড়িখানা তার পরনে এখনো আছে।হটাত জানলায় দুটো টোকা, মুহূর্তের জন্য সেখানে একটা ছায়ামূর্তির মাথা দেখা যায়। লাল বানুর চিন্তা করার ক্ষমতা সে আগেই হারিয়েছে। বাসবদত্তার মত রজনীর টানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে সে।আনিস ছলছল চক্ষে লাল বানুর হাত ধরে টানতে থাকে। আচ্ছনের মত আনিসের পিছু পিছু যায় লাল বানু। অগোছালো চুল আর মেলে দেয়া শাড়ির আঁচল জোছনার বাতাসে উড়ছে তার। আনিস মাঝে মাঝে অবাক মুগ্ধতায় লাল বানুর দিকে তাকাচ্ছে। হটাত চেতনা আসে লাল বানুর।
“ জোছনা! আমার জোছনা!” মুখ দিয়ে হাহাকার বের হয়ে আসে লাল বানুর। আনিস ভ্রূ কুচকে লাল বানুর দিকে তাকায়।
“ রাইত্তের বাস আইতে বেশি দেরি নাই, অহন চল।“

অবাক হয়ে যায় লাল বানু। ভাললাগার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু সে কখন ভাবেনি, ভাবতে পারেনি।
“ আমার জোছনা! আমার জোছনারে...” লাল বানুর কথা শেষ করতে দেয় না আনিস, আবার টানতে থাকে। “ কি করতাছেন আনিস ভাই! কই লইয়া যান আমারে?আমার জোছনার কি হইব?”
লাল বানুর কথায় যে আনিস বিরক্ত তা মুখ দেখেই বোঝা যায়।
“ জোছনার কতা ফাও ফাও মনে নেও ক্যা?” অনেকটা ধমকের স্বরে বলে আনিস।
“ আমি কুনখানে যাইবার পারমু না।“ লাল বানুর কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় আনিস। অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই আবার হাত ধরে টান দেয়। এবার ঝটকা মেরে হাতখানা ছাড়িয়ে নেয় লাল বানু, দৃঢ় কণ্ঠে বলে- “ আমি যামু না।“
লাল বানুর কণ্ঠের দৃঢ়টায় চমকে ওঠে আনিস। তীব্র তিরস্কারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে লাল বানু। পিছনে ফিরে ছুটতে থাকে সে। লাল বানুর গন্তব্য এক নরক। এই নরক থেকে ইচ্ছে করলেই বের হতে পারত সে। কিন্তু নরকের এক কোণায় ফুটে আছে একটা ফুল ,নরকের ফুল। নরকের ফুলের এই মায়ায় লাল বানু কখনো এই নরক থেকে বের হতে পারবে না। ফুলটাই লাল বানুর কাছে নরকের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ। আনিস দাঁড়িয়ে আছে। সে অস্পষ্ট চোখে লাল বানুর গন্তব্য পথের দিকে তাকিয়ে আছে, ওই তো, ভরা জোছনার বাতাসে অবাধ্য চুল উড়িয়ে লাল বানু তার গন্তব্যের দিকে ছুটছে, তার লক্ষ্য একটা ফুল, নরকের ফুল।

( সমাপ্ত)
( আমার জীবনের এ ধরনের প্রথম লেখা এটি। আমি কতটুকু সার্থক তা আপনারা জানেন। গল্পটার মাল-মশলা সংগ্রহ করতে আমাকে দুবার টানা তিন ঘণ্টা বস্তি পল্লীতে কাটাতে হয়েছে। বলাই বাহুল্য, অত্যাচারের দৃশ্যগুলো নিজ চোখেই দেখা। তখনই বুঝেছিলাম, লাল বানু শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবেও তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু, কত জন লাল বানুকেই বা আমরা চিনি......)

Comments

Popular posts from this blog