গল্পঃ অতি অ্যালার্জির গলায় দড়ি

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

# প্রায় রম্য গল্প

মোটামুটি বেশ ঘন একখানা ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে আছি।সন্ধ্যার সময় বলে চারপাশে বেশ শুনশান একটা নীরবতা। ঝোপের ঠিক পাশেই বেশ বড় সাইজের একখানা নর্দমা। সেখান থেকে যে দুর্গন্ধ আসছে তাতে নাড়ি উলটে আসার যোগাড় হয়েছে, তবু চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছি। কানের কাছে মশাদের নতুন একটা ব্যান্ড ক্রমাগত তাদের গান শুনিয়ে যাচ্ছে, ব্যান্ডের নাম সম্ভবত ‘ভন ভন বি পজেটিভ রক্ত চাই’। একেবারে ‘মিশন ইম্পসিবল ৭-চুলকিয়ে দেব’ সিনেমার নায়ক নায়ক অনুভুতি হচ্ছে।পাশের ঝোপে আমারই স্টাইলে একখানা নেড়ে কুকুর বসে রয়েছে, মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে জিভ ভাঙাচ্ছে। আমিও দু একবার তার দিকে জিভ ভাঙাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না। এখন উদ্দেশ্য কি তা যদি এক বাক্যে বলি তবে তা হবে- চুরি করতে এসেছি । তবে যা চুরি করতে এসেছি তার নাম বললে সাধারণ ছিটকে চোরও মনের দুঃখে চুরি ছেড়ে দেবে। চুরি করতে এসেছি একখানা গলায় বাঁধা দড়ি, তাও আবার যে সে দড়ি নয়, কাল ছাগলের গলায় বাঁধা দড়ি। ঘটনার মূলে যাওয়া যাক।

ছোট বেলা থেকেই অ্যালার্জি সম্পর্কে আমার মামা হয়, মানে সবসময় লেগেই থাকে। শীত- গ্রীষ্ম-বর্ষা যে ঋতুই হোক না কেন, আমি অ্যালার্জিতে শয্যাশায়ী থাকি। শয্যাশায়ী বলা ঠিক হবে না কারণ যারা অ্যালার্জির ভুক্তভুগি তারা জানেন যে তারা সবাই পার্ট টাইম নৃত্যশিল্পী। অ্যালার্জির প্রকোপ উঠলেই হাত পা থেকে শুরু করে যেখানে হাত পা পৌছায় না সেখানে চুলকাতে যে কসরত করতে হয় তা কোন দিক থেকেই নৃত্যের চেয়ে কম নয়। ক্যাডেট কলেজে সেবার অ্যাডমিশন দিতে গিয়ে দিগম্বর করার পর যখন ডাক্তার মহাশয় আমার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ সরু করে জানতে চেয়েছিলেন – অ্যালার্জি আছে নাকি হে ছোকরা?, তখন আমি আমার দশাসই মার্কা ভুঁড়ি ক্রমাগত প্রবল বেগে চুলকাতে চুলকাতে বলেছিলাম- কন কি ছ্যার! হেইডা আবার কি জিনিস! ডাক্তার সাহেব কেন চোখ সরু করে তাকিয়েছিলেন তা বুঝেছিলাম যখন ক্যাডেট কলেজ অ্যাডমিশনের রেজাল্ট বলছিল- তোমার মতো মোটাবুদ্ধির অ্যালার্জিযুক্ত ছাগলের হাত থেকে পরিত্রাণ পাইয়া আমরা গর্বিত। যাইহোক, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে নিজের অ্যালার্জি আরও বাড়াতে চাচ্ছি না, মূল প্রসঙ্গে আসি।

গত পরশু মামা, অর্থাৎ অ্যালার্জি মামা আমাকে আবার দেখতে আসলেন। তার জাঁকিয়ে বসার ধরণ দেখেই বোঝা গেল যে তিনি এবার সহজে বিদায় নেবেন না। ফলশ্রুতিতে সারা গায়ে লাল লাল ফোসকা ( ফুসকা নয় ) পড়ে গেল। আমার বাল্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। আমার এই চিকিৎসকের একটু ঝামেলা আছে, উনি যেকোনো প্রসঙ্গের মধ্যে বিয়ের পরবর্তী জীবনে পুরুষের প্রতি নারীদের অকথ্য নির্যাতনকে তুলে ধরেন। তার কথা শুনে বেশ বোঝা যায় যে তিনিও ভুক্তভুগি এবং বাংলাদেশে পেনাল কোড চালু হয়নি বলে তিনি এখনও পুরুষ নির্যাতন মামলা করতে পারছেন না। একবার তো মাঝরাতে তিনি আমাদের বাড়ি এসে বললেন, একটু ভাত দেয়া যাবে?তোর চাচি দুপুর থেকে খেতে দেইনি রে, মানিব্যাগটাও কেড়ে নিয়েছে। যাইহোক, তার কাছে যেতেই তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন- ফের মাংস খেয়েছিলি না ? আমি আমতা আমতা করতেই আমার জননীমাতা অতিউৎসাহী হয়ে বলে উঠলেন- সকালে দু কেজি মাংস রান্না করেছিলাম, দুপুর ভাত বাড়তে গিয়ে দেখি চেটেপুছে খেয়ে ফেলেছে পুরোটুকু। ডাক্তার চাচা রক্ত চক্ষু দিয়ে আমাকে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বললেন- বিয়ের পর যখন অসুস্থ হয়ে যাবি না, বউ তখন মাজায় লাথি মেরে বাপের বাড়ি চলে যাবে। আমি বহু কষ্টে মাজায় লাথি মারার দৃশ্যটা কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, আমার বউ আমার মাজায় লাথি মারছে......নাহ! দৃশ্যটা খুব একটা সুখকর মনে হচ্ছে না। ডাক্তার চাচা ফের জিজ্ঞাস করলেন- দু কেজি নিজেই সাবড়ালি কেন রে? আমি মাথা চুলকিয়ে বললাম- ইয়ে মানে, বাড়ির পাশে বিল্লিদের রিইউনিওন ছিল, ওখানে কিছু মুক্ত হস্তে দান করেছি। ডাক্তার চাচা খুব শান্ত স্বরে তার গুণধর অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন- বেতখানা একবার দে তো। এর পরে যা ঘটল তা এটা প্রমাণে যথেষ্ট যে বাংলাদেশেও উসাইন বোলট আছে।

চাচার ওষুধে মামা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কুসংস্কারই আমার কাল হল। কতিপয় অতি উৎসাহী বাঙ্গালি রমণী আসিয়া আমার জননী মাতার কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে গেলেন যে অ্যালার্জির অব্যর্থ ওষুধ হইল গলার দড়ি, তাও সাধারণ দড়ি নয়, কাল ছাগলের গলার দড়ি। এ দড়ি আনিয়া গলায় দিয়ে কিছুক্ষণ ছাগলের মতো বসে থেকে ভ্যা ভ্যা করে রামচিৎকার দিলেই অ্যালার্জি মহাশয় পত্রপাঠ বিদায় নেবেন। পাশের বাড়ির জরিনা চাচি এসে এই অভিনব পদ্ধতির কথা বলিলেন। পদ্ধতির কথা শুনে আমার জননী যতটা উৎসাহী হয়ে উঠলেন আমি ততটাই আশংকিত হয়ে পড়লাম। এরপর জরিনা চাচি যে শর্ত দিলেন তাতে আমার মনে হল যে চেঁচিয়ে বলি – চাচি তুই এদিকে আয়, তোকে ধরে থাবড়াই। চাচি বলিলেন- বুঝলা মিয়া, শুধু গলায় দড়ি দিলে হবে না, ওই দড়ি তুমারে চুরি কইরা আনা লাগব। আমি করুণ সুরে হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠলাম,
“ও চাচি গো, নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা,
সকাল বেলা অ্যালার্জির রোগী যে জন
চোর সে সন্ধ্যা বেলা”

চাচি একের পর এক ধাপ বলে যাচ্ছে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। হিটলার যদি জরিনা চাচির খবর পেত তবে গোয়েবলসের পশ্চাদ্দেশে লাথি কষে সেখানে জরিনা চাচিকে যায়গা দিত। আমাদের পাড়ায় ছাগল পোষেন একমাত্র মরজিনা চাচি। কিছুদিন আগে এই জরিনা আর মরজিনা চাচির ব্যাপক মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার মাঝখানে দুই মহিলা চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করছে, আশেপাশে বাঙালি বিনোদন নিচ্ছে, সবার হাতে তখন শোভা পাচ্ছিল মোবাইল। একজন তো ফেসবুক লাইভে গিয়ে রীতিমতো ধারাভাষ্য দেয়া শুরু করেছিল- হ্যাঁ বন্দুরা, আমরা দেইকবার পারতিচি যে জরিনা চাচি মরজিনা চাচির চুল ধরি আন্দারটেকিং শট দিতেছে। উরি মারামারি, এইবার মরজিনা চাচি পিলারের উপর উঠে ফ্লাইং মরজিনা কিক দিতেছে......। ভিডিও তা ইউটিউব এও খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভিডিওর টাইটেল ছিল- দেখুন কিভাবে মরজিনাকে টিরাস টিরাস করে মারল জরিনা।

জরিনা চাচি তাই অপমানের প্রতিশোধ আমাকে দিয়ে নিতে চাচ্ছেন, ছাগলের গলার দড়ি চুরি করিয়ে। আমার মাতা আমায় তাগাদা দিয়া বলিলেন- দ্রুত প্রস্তুতি লও বাছা, আজ নিশাবসানের পূর্বেই চৌর্যবৃত্তি সম্পন্ন করে ফেলিতে হইবে। কোন মা তার সন্তানকে এভাবে চুরির জন্য প্রস্তুতি নিতে বলতে পারেন বলে আমার জানা ছিল না। ফলশ্রুতিতে আমি এখন মশার ব্যান্ডের গান শুনে তাদের প্রতিভায় বিমুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছি, তাতে দু একটা মশা তালুর ভিতর চিৎপটাং।

একেবারে গিরগিটির মতো ছাগলের খোঁয়াড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, লক্ষ্য ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের গলার দড়ি। খোঁয়াড়ের ভিতর ঢুকতেই চোখে পড়ল সারি সারি ছাগল, যেদিকে দুচোখ যায়, ছাগল দেখিতে পাই। সর্ব নিকটে থাকা ছাগল খানার গলার দড়ির গিট খুলছি এমন সময় মরজিনা চাচির চিৎকার- ওই!! কোন ব্যাডার পো খোঁয়াড়ে কি করে রে! তাহার গলা শুনে আমার প্রাণ বায়ু বের হবে হবে ভাব, শুধু ফাঁক ফোকরের অভাব। চরম বিস্ময়ে আমি দেখলাম যে আমি চেঁচিয়ে বলছি- চুবো হারামজাদী, দেখতাছস না আমি গিট খুলবার পারতাচি না। বলেই একটা গিট খুলে আমি ভো দৌড়। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করে দেখলাম আমার পিছনে আরেকজন সঙ্গি হয়েছে, একটা ব্লাক বেঙ্গল ছাগল। আমি বেচারার গলার দড়ি নিয়ে এসেছি সেটা বেচারার সহ্য হয়নি, ইয়া লম্বা দুখানা শিং বাগিয়ে ধেয়ে আসছে, লক্ষ্য নিঃসন্দেহে আমার পশ্চাৎভাগ। দৌড়াতে দৌড়াতে হটাত করে মজা পুকুরে ধপাস, লেও ঠেলা।

আমি ফুলবাবু হয়ে বসে আছি, আমার গলায় একখানা দড়ি। মাঝে মাঝে তারস্বরে ভ্যা ভ্যা বলে চেঁচিয়ে উঠছি। অ্যালার্জি কমেনি, বরং মজা পুকুরে নাকানি চুবানি খেয়ে এখন লুঙ্গি পরে আছি। লুঙ্গি পরে চুলকিয়ে বড়ই মজা। মা মাঝে মাঝে বলে যাচ্ছেন- এই তো, সেরে গেল বলে। আমিও ভ্যাবলাকান্ত মার্কা হাসি দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে বলছি- তা বটে ভ্যা ভ্যা, ছাগলের গলায় দড়ি যখন পড়েছে ভ্যা ভ্যা, অ্যালার্জি তুই পালাবি কই।

Comments

Popular posts from this blog