ডায়েরির কোনো এক পাতা

    আসিফ মাহমুদ জীবন

মা বাড়ি নেই পাক্কা তিন দিন হয়ে গেল । বাবা,ছোটভাই আর মা গ্রামে মামাবাড়ি বেড়াতে গেছে, পরীক্ষার চাপে আমি বাড়ি রয়ে গেছি। বাড়িতে মেয়েমানুষ না থাকলে যে কি সমস্যায় পড়তে হয় এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভীষণ খাদ্যসমস্যা ! মা সামান্য রেঁধে রেখে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাতে তো ওই দুবেলা টেনে- টুনে চলল, তারপর নিজেরই রেঁধে খেতে হচ্ছে । হোটেলে যে যাব সেই উপায়ও নেই। গত বর্ষায় এক নামিদামি হোটেলে এক পেট খিদে নিয়ে নানরুটির অর্ডার হাকালাম। ওয়েটারের দেরি দেখে আমার আর তর সইল না, নিজেই রান্না ঘরে ঢুকে গেলাম। তার পরের দৃশ্যটা মোটেও সুখকর ছিলো না, একেবারে থিমেটিক দৃশ্য। রাধুনি চাচা উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার এক হাত রুটির কাচা খামিরে আর আরেক হাত উত্থিত লুঙ্গির ভিতরে নির্মমভাবে পশ্চাদ্দেশ চুলকানিতে ব্যস্ত।পাশের  দৃশ্যে দেখা গেল বছর বারোর এক চ্যংড়া ওয়েটার অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তার রসে ভরা নাকের ভিতরে খোঁচাচ্ছে , যেন সেই মুহূর্তে নাক খোঁচানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর নেই। তারপরই সেই হাত দিয়ে সদ্য প্রস্তুতকৃত নানরুটিখানা তুলে আমার টেবিলের দিকে হাটা দিয়েছে। বর্ষার সেই ক্ষীণ আলোতেও আমি স্পষ্ট দেখলাম, নানরুটির এককোণার লেগে রয়েছে প্রাকৃতিক সস।

ফোনে মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে দু একদিনের মধ্যে বাড়িমুখো ফেরার মতলব তার নেই। গতকাল বড় সাধ করে ভাত রাঁধার জন্য প্রেসার কুকারে চাল চড়িয়ে দিয়েছিলাম। মায়ের কথামতো চালের সাথে দ্বিগুণ পরিমাণ পানি। কিন্তু ভাত খাওয়ার সময় দেখলাম, সেটা আর ভাত হয়নি, আধা-চাল আধা-ভাত রয়ে গেছে। ফের কিছু পানি দিয়ে সেটা চড়িয়ে দেবার কিছুক্ষণ পরে যা বেরিয়ে আসলো সেটা না চাল, না পেস্ট , বরং দুটোর মাঝামাঝি অদ্ভুত গা গুলানো বীভৎস কোনো বস্তু। গতবছর এক হটাত প্রয়োজনে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে এক রোগীকে হড়হড় করে বমি করতে দেখেছিলাম। ভাতের অবস্থা দেখে আমার সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল। ভাত আর খাওয়া হলো না, দুমুঠো মুড়ি পাটালি  দিয়ে চিবিয়ে গিলে ফেললাম। প্রথমবার রান্না ঘরে গিয়ে মেয়েরা হাত পোড়ায় শুনেছি। নানি বলত, যে মেয়ের হাত যত বেশি পোড়ে, সংসারে তার রান্না নাকি তত বেশি স্বাদের হয়। ছেলেরা রান্না ঘরে গিয়ে কি করে তা নিজ চোখেই দেখলাম। শুধু হাত নয়, হাড়ি-তরকারি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেল তবু নিজের রান্নায় স্বাদের লেশমাত্র পেলাম না।

শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোনে রুপাকে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,” ভাই, বড্ড পেরেশানিতে আছি, তুমি এসে দুমুঠো রেঁধে দিয়ে যাও, পৈতৃক প্রাণখানা তো বাঁচাই।“             
রুপা আমার কান্না তোয়াক্কা না করে রাগত স্বরে  বলল,” আমি তোমার ভাই হই!?” 
আমি অনতিবিলম্বে দাঁতে জিভ কেটে বললুম,” ছি! ছি বোন! তোমায় ভাই বলে ডাকলে তো আমার নরকেও ঠাই হবে না।” রুপা উত্তর দিলো না, কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম রুপা ফোন রেখে দিয়েছে। আমি মোটেও বিচলিত হলাম না, আমি দিব্যি জানি যে রুপা রাঁধতে বসেছে, মেয়েটা খুব যত্ন করে আমার প্রত্যেকটা প্রিয় খাবার রাঁধবে। হয়ত ঘড়ির দিকে বারবার তার চোখ যাবে, এতো বেলা অব্দি আমার পেটে দানাপানি পড়েনি ভেবে চোখের দুকূল ছাপিয়ে নামবে দুর্বোধ্য জল, মুখে অস্ফুট কিছু শাসন। তারপর রঙিন ফুলওয়ালা সেই চিরচেনা টিফিনবক্সটা এনে আমার সামনে রেখে কপট রেগে বলবে, “এই শেষবার বলে দিলুম, আর রাঁধতে পারবো না।“ আমিও রুপার সে কথা শুনে ভ্যাবলাকান্তের মতো হাসব, কারণ আমি জানি, আমার জীবনের রান্নাঘরে মেয়েটা ছাড়া আর কোনো রাঁধুনির জায়গা হবে না।
                                                    
                              
      

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog