গল্পঃ শিমুল

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন


বৃষ্টি পড়ছে। মুষলধারে বৃষ্টি নয়, ঝিমঝিম করে বৃষ্টি। এ বৃষ্টিকে ক্যাটস এন্ড ডগস বলা যায় না, বড়জোর ক্যাটস এন্ড মাউস বলা যায়। বৃষ্টির নাম ঝিমঝিম এমনি আসেনি, ঝিমঝিম শব্দ সত্যি সত্যি পাওয়া যাচ্ছে। ছাদের উপর বৃষ্টি পড়ে ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে। তবে বৃষ্টির চেয়ে বাতাসের বেগ অনেক বেশি। বাড়ির সামনের শিমুল গাছটা বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে প্রবল বেগে মাথা নাড়াচ্ছে, যেন কোন কিছুতে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে, এমন হওয়াটা মেনে নিতে পারছে না তাই প্রবল বেগে হতাশায় মাথা নাড়াচ্ছে। গাছের মাথা নাড়া দেখে এ মুহূর্তে হিশাবুল্লাহ সাহেবের কথা মনে পড়ছে। হিশাবুল্লাহ সাহেবের মাথা নাড়ানোর দৃশ্য কল্পনা করে ফিক করে হেসে ফেলল হাসান। ফিক করে হেসে ফেলাটা ছেলেদের একদমই মানায় না, ফিক করে হাসার নিয়ম মেয়েদের। মেয়েরা ফিক করে হটাৎ হেসে উঠবে আর ছেলেরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে, সেটাই নিয়ম। সেই নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে হাসিটা হাসানের মুখে দিব্বি মানিয়ে গেছে। আজকেও চাকরির জন্য হিশাবুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল হাসান। ভদ্রলোক তার বাবার পুরনো বন্ধু, অতি অমায়িক মানুষ। পান খান, অতি যত্ন করে সেই পানের পিক পাশের ঝুড়িতে ফেলেন যেন পানের পিক ফেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর একটিও নেই। হাসানকে বাবা বলে সম্বোধন করতে তার একবারও ভুল হয় না। হাসান চোখ বুজে আজকে হিশাবুল্লাহ সাহেবের সাথে কথোপকথন মনে করার চেষ্টা করল, সমস্যা হল চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না, বৃষ্টিটা আজ হটাৎ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
“ আসসালামুয়ালাইকুম চাচা, ভালো আছেন?”
“ আরে বাবা হাসান! তোমার কথাই ভাবছিলাম একটু আগে। তোমার বাবার শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে?”
“ জি চাচা। বাবা পাঠালেন, আপনি এ সপ্তাহে আসতে বলেছিলেন একটা চাকরির ব্যাপারে...”
সেই মুহূর্তে হিশাবুল্লাহ সাহেবকে উত্তর দিতে দেখা গেল না, তিনি অতি যত্ন সহকারে পানের পিক ফেললেন, ড্রয়ার থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। সাদা রুমালে পানের পিকের ছোপ ছোপ দাগ লেগে রুমালটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। হাসানের ক্ষীণ সন্দেহ হয় যে হিশাবুল্লাহ সাহেব পানের পিক ফেলার নাম করে অপ্রিয় কথাগুলো বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। হাসান এবার দিয়ে মোট তেরো বার হিশাবুল্লাহ সাহেবের কাছে গেল, প্রত্যেক বার হিশাবুল্লাহ সাহেব সবশেষে প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলেন, “ চাকরিটা বস তার আত্মীয়কে দিয়ে দিয়েছেন, বুঝলে হাসান। বস আমার মাইডিয়ার টাইপের লোক কিন্তু উনার এক আত্মীয়র অনুরোধ উনি ফেলতে পারেননি। তুমি সামনের মাসে একবার এসে ঘুরে যেয়ো, ঠিক আছে? বুঝলে বাবা, তাড়াহুড়া ভালো না। আল্লাহ তায়ালা কোরান শরিফে বলেছেন, হে মানবসন্তান! তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। এটা কোন সূরা যেন বাবা?”
হাসান উত্তর দিলো না,সে জানে এটা কোন সূরা, সে বলবে না। এটা এক ধরনের খেলা। হিশাবুল্লাহ সাহেব ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে আছেন, কোন সূরা মনে করার চেষ্টা করছেন, মনে করতে পারছেন না। হাসান তা দেখে রাগের মধ্যেও মজা পাচ্ছে।
“ চাচা, আমি আসি?”
“ হ্যাঁ, সামনের মাসে মনে করে এসো কিন্তু, ভুলে যেয়ো না। রহমত কে বোলো আমি চেষ্টা করছি।“
হাসান চলে আসছে, পিছনে হিশাবুল্লাহ সাহেব প্রবল বেগে মাথা নাড়ছেন, একটু এদিক ওদিক হলেই মাথা খুলে চলে আসতে পারে।

হাসানের আবার দমকা হাসি পেয়ে গেল। আচ্ছা, দমকা বাতাস হয় , দমকা হাসি হতে সমস্যা কি? হাসানের মাথায় এখন হিশাবুল্লাহ সাহেবের প্রবল বেগে মাথা নাড়ানোর দৃশ্য ভাসছে। সামনের শিমুল গাছটা হটাৎ করে মাথা নাড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। গাছটা রাগ করল নাকি হাসার কারণে, মানুষের মতো গাছেও রাগ করে? হাসান গাছের সাথে দূর থেকেই কথা বলার চেষ্টা করছে।
“ শুভ বিকাল মিঃ শিমুল”
“ আমি শিমুল নই, শিমুল গাছ। আর বিকালটা মোটেও শুভ মনে হচ্ছে না।“
“ আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?”
“ রাগ অতি তুচ্ছ আবেগ, তোমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের রাগ সাজে, আমাদের সাজে না।“
“ ও, আচ্ছা, মিঃ শিমুল গাছ, আপনি রবীন্দ্রনাথকে চেনেন? কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ?”
“ না, আমার কাওকে চেনার প্রয়োজন পড়ে না।“
“ উনার বৃষ্টি নিয়ে ওই কবিতাটা শুনেছেন? নীল নভগণে আষাঢ় গগণে তিল ঠাই আর নাহিরে, ওগো তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে। উনি বৃষ্টির দিনে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছেন, আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন! জানেন বৃষ্টিতে আজকাল এসিড থাকে?আপনি রূপচর্চা করেন?”

শিমুল গাছটা কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো, তার আগেই নিলু চা নিয়ে হাজির।
“ দাদা, তোর চা।“ নিলু এক কাপ চা নিয়ে আসেনি দুই কাপ চা নিয়ে এসেছে। তার মানে গল্প জুড়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য। মেয়েটা প্রচণ্ড কথা বলতে পারে। হাসানের মাঝে মাঝে মনে হয় নিলুর যার সাথে বিয়ে হবে সে বেচারার কথার জোরে দুই দিনেই মাইগ্রেনে শয্যাশায়ী হবে।
“ আমি তো চা চাইনি।“
“ খেয়ে দেখ! আমি মধু দিয়ে বানিয়েছি।“
“ মধু কোথায় পেলি!”
“ নিহি খালার কাছ থেকে এনেছিলাম। শোন দাদা, আজ কি হয়েছে! আমি...”
‘ “ আমার ভালো লাগছে না রে, তুই যা” বলেই হাসানের খারাপ লাগল। নিলু চলে যাচ্ছে, মেয়েটা খুব অভিমানি। একবার চলে গিয়েছে, এদিকে আজ আর আসবেনা। হাসানের ইচ্ছে হল নিলুকে ডেকে হাত ধরে ছোটবেলার মতো কোলে বসাতে, আর কদিন পর তো কথাই বলা হবেনা। নিলুর জন্মের পর রাহেলা বানু মিটিমিটি হাসছিলেন।
“ হাসান রে, তোর তো ভাগ্য ভালো। তুই দুটো মা পেয়ে গেলি। এইটা হবে তোর দুই নম্বর মা।“
হাসান হেসেছিল, তার সপ্তাহ দুয়েক পরেই দু দিনের জ্বরে রাহেলা বানু মারা গেলেন। মরার আগ পর্যন্ত তার টনটনে জ্ঞান ছিল। হাসানকে ডেকে বলেছিলেন, “ বোনটাকে দেখিস বাপ, তোর আব্বা যদি তোরে মারে তো রাগ করিস না। আর যদি তোর আব্বা আবার বিয়ে করে...” এ পর্যন্ত বলেই হেসে ফেলেছিলেন রাহেলা বানু। মায়ের স্মৃতির কথা মনে করতে গেলেই প্রথমে হাসির কথা মনে আসে হাসানের, কি অদ্ভুত সুন্দর হাসি! হাসানের ইচ্ছা করছে নিলুকে ডেকে বলে, “ জানিস নিলু? তুই দেখতে অবিকল মায়ের মতো। নিলু, একটু হাস তো, তোর হাসি দেখি।“
এখনো ঝিমঝিম করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে । হাসান জানে এখন হাজার ডাকলেও নিলু আসবেনা, প্রচণ্ড অভিমানি সে। অভিমানি আরেকটা মেয়েকে হাসান চিনত । চিনত? এখন বুঝি চেনেনা?নিশিকে নিয়ে এই বৃষ্টিতে হটাৎ খুব ভিজতে ইচ্ছা করছে হাসানের। মেয়েটার বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, কিন্তু বৃষ্টিতে একদমই ভিজতে চায়না, ভিজলেই ঠাণ্ডা লাগবে। হাসান একবার জোর করে ভিজিয়ে দিয়েছিল বলে নিশির সে কি রাগ!বৃষ্টির মধ্যে শিমুল ফুল হাতে নিয়ে নিশির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে অভিমান ভাঙাতে হয়েছিলো,শিমুল ফুল খুব প্রিয় ছিল মেয়েটার। নিশির বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হল। আচ্ছা? নিশি কি এখনও বৃষ্টিতে ভেজে নাকি ঠাণ্ডার ভয়ে এখনও জানলার ধারে বসে থাকে? হটাৎ হাসানের মনে হল তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি পড়ে রয়েছে। তড়িঘড়ি করে জামাটা গায়ে চাপিয়ে বাইরে পা দেয়ামাত্র হাসান ভুলে গেল কি জন্য সে বাইরে বের হয়েছিলো। ধীর পায়ে শিমুল গাছটার নিচে গেল হাসান, আপাতত কথা বলার একজন সঙ্গি পাওয়া গেছে।
“ আচ্ছা মিঃ শিমুল গাছ? আপনি শিমুল ফুল ভালবাসেন? নিশি খুব শিমুল ফুল ভালবাসত জানেন?”
“ আমার ফুল, আমি ভালবাসব না? তুমি এ কি কথা বল হে ছোকরা!”
“ নিজের ফুলগুলোকে যদি এতই ভালবাসেন তবে এমনভাবে ঝরে যেতে দিলেন কেন?”
হাসানের মনে হল শিমুল গাছটা হাসছে। হাসার তো কোন কারণ নেই! হাসান কি কোন ছেলেমানুষি প্রশ্ন করেছে?
“ ভালবাসার মূল নিয়মটা তুমি জানোনা বুঝি? ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হয়ে চারদিক, দিগ্বিদিক। ভালবাসাকে পুষে রেখে কি লাভ বল যদি তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা না থাকে?”
বাতাস আবার বইতে শুরু করেছে। শিমুল গাছটা আবার হিশাবুল্লাহ সাহেবের মতো মাথা নাড়তে শুরু করেছে। হাসানের কেন জানি মনে হল শিমুল গাছটা এবার মাথা নাড়িয়ে হাসছে, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার আনন্দে হাসছে। হাসান কয়েকটা শিমুল ফুল কুড়িয়ে নিল।
ভেজা রাজপথ, ঝিমঝিম বৃষ্টি। তার মধ্যে এক তরুন হাতে কয়েকটা শিমুল ফুল নিয়ে ধীরলয়ে হাঁটছে। তার হাঁটা আজ উদ্দেশ্যবিহীন নয়, সে আজ ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য হাঁটছে, ঠিক শিমুল গাছটার মতো।
( আজকের রাতের ঝিমঝিম বৃষ্টি দেখে লেখা)
                                          
                               

Comments

Popular posts from this blog