বিষয়ঃ কলেজ ভর্তি বিভ্রাট (ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা+ অতিরঞ্জিত কল্পনা)

লেখক ও প্রত্যক্ষদরশিঃ আসিফ মাহমুদ জীবন


হাতের দশ আঙুল কি প্যাডের উপর দ্রুত চলছে, মাঝে মাঝে মৃদু ক্লিক ক্লিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনিটরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ৬ জোড়া চোখ, তাদের নিস্তব্ধতায় বুকের ধুকধুক শব্দ শোনা যাচ্ছে কয়েকগুন বেশি জোরে। হটাৎ করে পর্দায় ভেসে উঠল কতোগুলো সংখ্যা। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো অর্থহীন মনে হলেও সংখ্যাগুলো দেখে চারদিকের নিস্তব্ধতা খানখান করে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, তাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। বর্ণনাটা আসলে আমাদের কলেজ ভর্তির মুহূর্তের, জীবনের একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে এটি।
জুন মাস হতে না হতেই আমাদের প্লান হতে লাগলো কলেজে কি করে একসাথে সিট করা যায়, কেন একসাথে করব তা নিশ্চিত বলে দিতে হবেনা ? কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন, এ কথাটার অর্থ বুঝলাম যখন ২৭ তারিখ সকাল বেলায় গিয়েই দেখলাম, চারদিক হাউজফুল। গার্লস স্কুলের বাঘা বাঘা তরুণীরা মিলে ততক্ষণে কয়েকটা দোকান দখল করে ফেলেছে, আমরা অনাথ বিড়াল ছানার মতো যেদিকেই যাই, শুধু হাউজফুল দেখতে পাই। সাহস করে কয়েকজন পরিচিত তরুণীর পিছনে আমরা জড়ো হলাম এই আশায় যে যদি তারা দয়া করেন! বৃথা আশা ছিল,তারা আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যার অর্থ হতে পারে, ‘ভাগ ইহাসে’। আমরাও তৎক্ষণাৎ চম্পট দিলাম, বাঘিনী সম্প্রদায়ের হাতে অকালে প্রাণ হারানোর কোন ইচ্ছা অন্যদের থাকলেও আমার নেই।
চারদিকে যখন শুধু ২০ ওয়াটের বাতির মতো অন্ধকার দেখতে পারছি তখন এক বন্ধু সেই বাতিও টুপুস করে ফাটিয়ে দিল। তার ভাষ্যমতে, আমাদের ভাবি (তার কিন্তু ভাবি নয়) রাতে ভর্তি হবেন, সেজন্য আমাদেরকেও রাতে আসতে হবে। আমি ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে অবাক হয়ে দেখলাম সবাই তার প্রস্তাবে অতিরিক্ত খুশি হয়ে সম্মতি দিচ্ছে। পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলাম, আমার কোন ভাবিই নাকি দিনের বেলা ভর্তি হননি, তাই সবার এত ষড়যন্ত্র! আমি ব্যাথিত হৃদয়ে বন্ধুদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। বাড়ি এসে কেকা ফেরদৌসির নুডুলসের জিলাপি রেসিপি যখন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি তখনই আমার আধমণ ওজনের আমপাড়ার মোবাইলটা ডিংচাক পূজার ‘মলম মাখাব’ গান বাজিয়ে জানান দিল কোন এক বজ্জাত ফোন দিয়েছে। ফোনে যা শুনলাম তাতে আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে বের হবার মতো অবস্থা হল। কয়েকজন পুরুষদর্শন তরুণী ঝিনাইদহের অধিকাংশ দোকান দখল করে নিয়ে সেখানে বাচ্চা ছেলেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। আমি সারাজীবনই কাজি নজরুলের আদর্শ মেনে চলি, এ অন্যায় মেনে নেয়া যায় না। দেশের দখল নারীর হাতে বলে বলে দোকানের দখলও দোকানদার বেচারার হাতের থাকবে না! সব কটা সাঙ্গপাঙ্গ কে খবর দেয়া হল,সেই কথোপকথনের কিছু অংশ দেয়া হলঃ
(১)
আমিঃ বন্ধু, এক্ষুনি চলে আসো। ভর্তি এখনি হতে হবে, যদি সোজাভাবে ভর্তি হতে না দেয় তবে আমরা...আমরা............ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসবো, কি আর করা যাবে!
বন্ধুঃ কিন্তু ও যে রাতে ভর্তি হবে !
আমিঃ গুল্টি মারি তোর ও’র। এক্ষুনি না আসলে তোর পিঠে চামড়া থাকবে না।
(২)
আমিঃ বন্ধু, দ্রুত চলে আয়, কি করছিস?
বন্ধুঃ মনের দুঃখে গাঁজা খাই বন্ধু। ( কাঁদোকাঁদো স্বরে) ও আমার সাথে কি করে এমন করতে পারল বন্ধু, আমি একটু দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম ভর্তি হওয়ার আশায়, আমাকে এভাবে লাথি মেরে কেন তাড়িয়ে দিল!! কেন!!!
(৩)
আমিঃ মশা, দ্রুত অ্যারসল নিয়ে চলে আয়, ভর্তি হতে হবে।
মশা(ছদ্মনাম)—আমি রাতে হব ভাই
আমিঃ দেশে এখন চারদিকে এত উত্তাল অবস্থা, চারদিকে মেয়েদের রাজত্ব। এসব তরুণী মেয়েদের লালসার স্বীকার হয়ে আমাদের মতো কত বাচ্চা ছেলে ঘরের কনে আজ জবুথুবু হয়ে বসে থাকে। সেই মেয়েদের করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামান্য আন্দোলনও তুই করবি না!?
মশা(ছদ্মনাম)—বন্ধু, ও জানতে পারলে আমাকে থাবড়িয়ে মেরে ফেলবে। আমি পারব না।
আমিঃ বুকে বল, আই মিন, বুকে সাহস রাখো বন্ধু। পুরুষের মুক্তি একদিন হবেই।
মশা(ছদ্মনাম)—তোর তো আমাদের মতো ও’ যোগার করার মুরোদ নেই, তাই তুই এমন বলিস।
( টিপ টিপ, এই মুহূর্তে এ সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন)
আমরা একটা দোকান অবশেষে পেলাম, দোকানের মালিক চারদিকে মেয়েদের কর্মকাণ্ড দেখে দোকানের শাটার নামিয়ে ৩৮ সেলসিয়াসেও কম্বল মুড়িয়ে ছিলেন। আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে একবারে আমাদের সামনে এসেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেললেন। পাশে পানির বোতল ছিল, সেখান থেকে দু এক ফোঁটা পানি নিয়ে আমিও একটু কাঁদার চেষ্টা করলাম, একেবারে বাংলা সিমেমা সিনেমা অবস্থা।
বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে, মেয়েরা ইতোমধ্যে ক শাখা দখল করে ফেলেছে। আমরা অনাহারে রয়েছি সকাল থেকে, কিন্তু দোকানের বাইরে যাবার সাহস পাচ্ছি না, যদি কিছু ঘটে যায়! কমিউটারে অনেকগুলো ট্যাব পরপর খোলা হয়েছে, সবগুলোতে ডাটা এন্ট্রি করা হলেও সেভ বাটনে ক্লিক করা হয়নি। আমরা সবাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছি, একসাথে পরপর সবকয়টা সাবমিট করা হবে। হটাৎ বন্ধ শাটারে বাঘিনীর আঁচড়ের শব্দ শোনা গেল, আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল, আমাদের সময় শেষ! আমাদের এক বন্ধুকে মোনাজাত ধরতে বলা হল, সে তৎক্ষণাৎ মোনাজাত ধরল, আমরা কাঁপছি আর মোনাজাত করছি। শাটারে ততক্ষণে কয়েকটা বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক সে সময় দৌড়ে সবকটা সাবমিট বাটনে ক্লিক করে দিলাম, অবশেষে কাজ সমাপ্ত হল। আমরা যা চেয়েছিলাম তাই হল, নাফিজ ইনতিসারের ২৯৬, আসিফ মাহমুদ জীবনের ২৯৭, এ কে এম মুহতাসিম ফুয়াদের ২৯৮, মেহেরাব জামান জিসানের ২৯৯, হাসিবুর রাহমানের ৩০০, ইমামুল এহসান রাফিমের ৩০১। আমাদের উল্লাস দেখে কে! কিন্তু উল্লাস ভেস্তে গেল যখন জানলাম যে ২৯৬ এর আগে কতিপয় ভয়ংকর বাঘিনী ক্রুদ্ধ গর্জন করছে। ২৯৬ ওরফে নাফিস ইনতিসার এখন আমাদের কাছে ভারত-পাকিস্তানের সীমানা। মনের দুঃখে আমরা ‘ভাত দে’ শীর্ষক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিরিয়ানি গলঃধরণ করলাম, আমাদের খাওয়া দেখে হোটেল বয়গুলো পর্যন্ত চুকচুক করে সমবেদনা জানালো। এক একজন প্রকাণ্ড ভুঁড়ি নিয়ে যখন বাইরে আসলাম, চারদিক তাকিয়ে মনে হল মনে হল, পৃথিবীটা ভারী সুন্দর!
                               

Comments

Popular posts from this blog