গল্পঃ নীলিমা

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল মায়ের কাছে ফোন দিলেই মা ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা তুলছেন। অবশ্য তোলার এ কথা। বয়স তো নিতান্ত কম হল না, পঁইত্রিশ ছুঁইছুঁই করছে। উদরের প্রস্থছেদ যেমন ক্রমেই বাড়ছে সেই সমান হারে কমছে মাথার চুল। শেষ বার ফোন করে তো রীতিমতো হুমকি দিয়ে বসলেন যে বিয়ে না করলে আর কথাই বলবেন না। এদিকে মাজেদা খালা গোপনে খবর দিলেন মা নাকি আশেপাশের চার পাঁচটা জেলা পুরো চষে ফেলেছেন পাত্রী খুজতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই বাড়ির দিকে রউনা দিয়েছি। ট্রেনে চড়লেই আমার কেন এক অদ্ভুত কারণে বমি বমি লাগে, অথচ দুর্মূল্যের বাজারে যে চাকরি জুটেছে তাতে ট্রেনের চেয়ে সস্তা কিছু কপালে জুটবে না। দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় উঠে একখানা সিট খুঁজতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হল। ব্যাগটা কোনোমতে ঢুকিয়ে সিটে জবুথবু হয়ে বসতেই সামনে এক জোড়া চোখকে দেখলাম আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চমকে উঠলাম আমি, যতটুকু চমকে ওঠার দরকার ছিল তার থেকে বেশিই চমকেছি, এ চোখজোড়া আমি চিনি, বেশ ভাল করেই চিনি।

নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। বাবা নিম্নশ্রেণীর সরকারি চাকরি করতেন বিধায় সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে হতো। বাবার ট্রান্সফার হতো ঘন ঘন, প্রায়ই নতুন যায়গায় থিতু হতে মন্দ লাগত না। সেবার কেবল কলেজে উঠেছি। চোখে নতুন নতুন স্বপ্ন, নতুন নতুন বাসনা। বাড়ি ফিরতেই কেন জানি মনে হতো একজোড়া চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি বারবার সে চোখের হদিস বের করার চেষ্টা করেছি, পারিনি। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সেই চোখের মালিক নিজে এসেই ধরা দিলেন। সেদিন বাড়ি ফিরে দেখি নিতান্ত এক কিশোরী আমার মায়ের সাথে খোশগল্পে মত্ত। কিশোরীর চোখ দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম, ঠিক আজকের মতো অনুভূতি হয়েছিলো, এ চক্ষুদ্বয় আমার চেনা, আমি বেশ চিনি। সেদিনই জানতে পারলাম, পাশের ফ্লাটের রহমত সাহেবের ষোড়শী একটা মেয়ে আছে। নীলিমা সেদিন আমার সাথে কথা বলেনি, কিন্তু তার সেই মায়াবি চোখের অস্থিরতা বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কলেজ থেকে যখনই ফিরতাম, জানলায় একটা মায়াবি মুখ দেখা যেতো, যেন তীর্থের কাকের মতো কেউ আমার অপেক্ষায় ছিল। জানলাটার দিকে ফিরতেই সে মুখখানি টুপ করে অদৃশ্য হয়ে যেতো, এ এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা।

ঈদের দিন নীলিমাকে প্রথম শাড়ি পরে দেখেছিলাম, সত্যি বলছি, চোখ ফেরাতে পারিনি।নীল শাড়িতে আকাশের নীল রোদ্দুরের মতই লাগছিলো নীলিমাকে। আমার সে চোখের ভাষা বোধহয় নীলিমা বুঝেছিল, নইলে ফর্সা দু গাল রক্তকরবীর মতো লাল হয়েছিলো কেন! সেদিন প্রথম জড়তা ভেঙে বলেছিলাম, জানেন, বিড়ালচোখী মেয়েদের কপালে ভাল স্বামী জোটে না। নীলিমা ফিরতি উত্তর দিয়েছিল, আপনি তো বেজায় খারাপ। নীলিমার সে উত্তরের মর্মার্থ আমি বুঝেছিলাম ঠিকই কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। তারপর লুকোচুরি খেলাটা আর রইল না, চোখের খেলা শুরু হল। কি এক অদ্ভুত আবেশে সেই জানলা আমার বড়ই আপন মনে হতো। মোটা গরাদের ওপাশে যে আরেক সত্ত্বা আমার উপস্থিতি টের পেতো তা বেশ ভাল করেই জানি, তবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, ভাল লাগত।

‘ জানেন না যে গাছের ফুল ছিঁড়তে নেই।‘ সেদিন ছাদে ফুল তুলতে গিয়ে নীলিমার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠেছিলাম। আমি ঘোরলাগা দৃষ্টিতে নীলিমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, নীলিমা ফের লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই আমাদের দুজনের রুটিনে ছকবাধা হয়ে গিয়েছিলো ছাদে যাওয়া। দু জন ছাদের দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতাম, দুদিকে মুখ করে। কিন্তু দুজনের অস্থির চঞ্চল চোখ আর মুচকি হাসি একে অপরকে জানান দিত, এইতো আমি।

সুখ কেন জানি আমার কপালে খুব একটা সয় না। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হলনা। বাবার হটাত বদলির খবর আসলো। বেশ মনে আছে সেদিন বাথরুমে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছি, দু হাতের চেটো দিয়ে কান্নার জল মুছবার চেষ্টা করেও পারিনি, কিন্তু আমি কেন কেদেছিলাম! নীলিমার কাছে খবরটা যেতে দেরি হয়নি। ছাদে সেদিন প্রথম কাছে এসেছিল নীলিমা। নীলিমার ফোলা চোখ দেখে বুঝতে সমস্যা হয়নি যে বিধাতা আমাকে একলা কাঁদাননি। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে নীলিমা বলেছিল,’ মাহমুদ ভাই, আপনি যাবেননা।‘ নীলিমার সে ব্যগ্র কণ্ঠ আমার বুকে শেলের মতো বিঁধেছিল, আমি উত্তর দিতে পারিনি, শুধু জলভরা সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কেউ কি নীলিমাকে বলেনি যে কাঁদলে ওকে কতটা সুন্দর দেখায়! তাই বুঝি বিধাতা কাঁদতেই ওকে এই জগৎসংসারে পাঠিয়েছিলেন। নীলিমার হাতের কম্পন আমি টের পেয়েছিলাম, কি ছিল সেই কম্পনে, হারাবার ভয়?নীলিমার চোখের জল সেদিন শ্রাবণের বারিধারায় মিশে গিয়েছিলো। কে জানে, প্রকৃতি হয়ত এভাবেই নিজের অভিমান ঢেকে রাখে। আমি চলে আসছিলাম বটে কিন্তু চোখ ছিল জানলার দিকে।অস্পষ্ট চোখে দেখেছিলাম একটা মূর্তি সেখানে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানি অবুঝ চোখজোড়া আবার আমাকে খুঁজবে, আমাকে খুজে না পেয়ে হয়ত মায়াবি সে চোখ ভিজে যাবে, কিন্তু সে দৃশ্য আমি আর দেখতে পাব না। সে বয়সে কত কিই না কল্পনা করতাম! অলীক সেসব কল্পনা আজ আমার হাসির খোরাক। ভাবতাম, হয়ত বাবার ফের বদলি হবে, আমি একমুঠো নীল পদ্ম নিয়ে নীলিমার কাছে যাব। নীলিমার সামনে গিয়ে বলব, নিলিমা, দেখ, আমি এসেছি। নীলপদ্ম হাতে এসেছি। কল্পনাগুলো নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখে কল্পনাই থেকে গেছে। বাস্তব হয়ে ওঠেনি। আমার আজও মনে আছে, বসন্তের এক সন্ধায় বাবা এসে মা কে বলেছিলেন,’ শুনছো? রহমতের বড় মেয়েটার আজ বিয়ে হয়েছে।‘ এ কথা শুনে বসন্তের কলকাকলিতেও আমার বুকে বোশেখের ঝড় উঠেছিল। না, আমি কাদিনি, শুধু এই ভাবছিলাম যে নীলিমা কি আমার নীলপদ্মগুলো আর নেবেনা?

৭ বছরে অনেক কিছু হয়েছে। বাবা মারা গেছেন তাও বছর তিনেক হল। আমি পড়াশোনাটা শেষ করে একটা হাইস্কুলে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি। ছোট ভাইটা বিয়ে করে ফেলেছে অথচ আমি এখনও কৃতদারবৃত্তিতে প্রবেশ করিনি বলেই মায়ের এত ক্ষোভ।

আমার সামনে নীলিমা বশে আছে, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। সেই কিশোরী নীলিমা আজ আর কিশোরী নেই, বাস্তবতার টানে আজ পুরদস্তুর ঘরোয়া বউ সে। কিন্তু চোখদুটো? চোখদুটো সেই আগের মতই মায়াবি-চঞ্চল। মৌনতার অবসান নীলিমাই করল,’ কেমন আছেন মাহমুদ ভাই? চিনতে পারেননি?’
নীলিমার মুখে হাসি দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বারবার একটা প্রশ্নই মাথায় আসছিলো, আমি কি পারতাম না নীলিমার মুখে এমন হাসি ফোঁটাতে? নীলিমা বুঝি খুব সুখেই আছে? নীলিমার মুখের নির্মল হাসি তো তাই বলে, তবে নীলিমার চোখ ভেজা কেন!
‘ ভাল আছি নীলিমা, আপনি ভাল আছেন?’ বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে শব্দগুলো উচ্চারণ করলাম।
‘ আপনি করে বলছেন যে, আগে তো আপনি করে বলতেন না!’
শত কষ্টেও হেসে ফেললাম। এক মহাশক্তিধর মানুষ নামের অদ্ভুত এ প্রাণীকে কি সুন্দর অভিনয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন! সে চাইলেই তার অতীতকে নিমেষে ভুলে যেতে পারে। কোন পিছুটান নেই!
পাশে এক প্রায় বৃদ্ধকে ঘুমাতে দেখলাম। আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে নীলিমা বলল,’ আমার স্বামী। ‘ দীর্ঘশ্বাসটা বুকের গভীরেই চাপা দিতে চেয়েছিলাম, পারলাম না। আমার সে দীর্ঘশ্বাস নীলিমার চোখ এড়ায় নি।
‘ মাহমুদ সোনা, এদিকে এসো।‘ নীলিমার কথা শুনে চমকে উঠলাম, এ কি বলছে নীলিমা! সমাজের শেকল তো এত ঠুনকো নয়। ঠিক সে সময় কোত্থেকে এক দেবশিশু নীলিমার কোলজুড়ে বসল।
‘ আমার ছেলে, মাহমুদ’ কথাটা বলেই মুচকি হাসল নীলিমা। সে হাসিতে অভিমান ছিল, অভিযোগ ছিল আর ছিল হতাশা। হতাশা কি বলা চলে?নাহ, নীলিমা তো সুখেই আছে। নারীর মন বুঝি এতটাই চাপা! পুরনো ধূলিময় অতীতকেও তারা বুকে ধরে থাকে, নিজের আবেগকে চাপা দিয়ে ঠিক হাসিমুখে থাকতে পারে! কই, আমি পুরুষ হয়ে তো তা পারিনি!

পরের স্টেশনেই নেমে এলাম, অদ্ভুত সুন্দর একজোড়া জলে ভেজা চোখ পুরনো দিনের মতো আমার দিকে চেয়ে থাকবে এ আমি সইতে পারব না। আমার জীবনের আকাশে একখণ্ড নীলিমার মেঘকেই আমি যায়গা দিয়েছিলাম, সে সময়ের জাঁতাকলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছে। থাকনা আকাশটা শরতের কোন বিকেলের মতো মেঘশূন্য, আরেক নীলিমার কি দরকার! সেও হয়ত একদিন বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাবে। সেদিন শ্রাবণে আকাশটা মেঘলা ছিল, আজও আছে।আমি নীলপদ্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, টিপটিপ করে মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে। হে আকাশ, তুমিও বুঝি আজ মেঘের বিচ্ছেদে বিষণ্ণ? শ্রাবণকে আজ বড্ড জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, শ্রাবণ, তুমি কি শুধু বিচ্ছেদের গানই গাও?
(সমাপ্ত)
                 

Comments

Popular posts from this blog