গল্পঃ রক্ত ও গোলাপ
লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন
স্কয়ারের নির্জন একপাশ ধরে মাথার উপর ভারী কাপড় জড়িয়ে এলিনা
দ্রুত হাঁটছে । এলিনাকে দেখে বোঝা শক্ত যে তার বয়স ত্রিশের কোঠায়। দুপাশে বিনুনি করে চুল বেধে দিলেই চোখে মুখে সদ্য কিশোরিভাব প্রকট হয়ে ওঠে। মস্কোতে শীতকালগুলো বড্ড বেশি ঠান্ডা হয়, গৃহস্থ বাড়িতে চিমনির আগুনের পাশে বসে বাড়ির ছেলেপুলে আর বুড়োরা
গল্প জুড়ে দেয়।
সেন্ট স্কয়ারের চৌহদ্দি পেরিয়ে আবাসিক অঞ্চলের দিকে দ্রুত পা
বাড়ালো এলিনা। তার গায়ে ট্রাকসুটের উপর পশমওয়ালা সুয়েটার, গত শীতে কিনে রেখেছিল, এখন কাজ দিচ্ছে। প্রচন্ড
শীতে এলিনার মুখ বরফের মতো সাদা হয়ে আছে, সাদা মুখে লালচে লালচে ছোপ, চোখের দৃষ্টি পাগলের মতো উদ্ভ্রান্ত। মাত্র
ঘন্টা তিনেকের ব্যবধানে সাজানো গোছানো জীবনে এমন সাইমুম হানা দেবে তা সে কখনো কল্পনাও
করেনি। জুরালিনা ভবনের পাশ দিয়ে নোংরা একখানা শুড়িখানায় ঢুকল এলিনা। বারের
দিকে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো সে, না! ভদকা-মদ কিছুই ছোঁয়া চলবে না। দরকার
হলে আগুনের পাশে বসে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নেবে তবু মদ নয়। বাম হাত
সন্তর্পণে আলতো করে তলপেটে ছুইয়ে দিলো এলিনা। হ্যাঁ, দিব্যি বোঝা যাচ্ছে ! অস্তিত্ব মাত্রই তো নিজের উপস্থিতি
ক্ষণে ক্ষণে জানান দেবে।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে মস্কোতে বছর ছয়েক আগে এসেছে এলিনা। বাবাকে
সে কখনই দেখেনি, মায়ের কফিনে স্মৃতির শেষ পেরেকটা ঠুকে তার এ পথে পা বাড়ানো। আমেরিকান
এম এই সিক্সে যে কজন রাশিয়ান যুবা ছিল তার মধ্যে হঠাত এলিনার জায়গা জুটে গেল। উল বুনানো
কাটা হাতে থাকা সদা ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটার হাতে যে কি করে আগ্নেয়াস্ত্র উঠলো তা এলিনা
নিজেও কখনো টের পায়নি। নিজ দেশের লোক, অথচ সবাই যেন শত্রু । শ্ত্রুর দলে হটাত নতুন
বন্ধু জুটলো এলিনার। এজেন্সির সিনিয়র এজেন্ট , ভেক্টর রেজনোভ। মরুর বুকে এ যেন তৃষ্ণার
জল! মা মরার পরে এই প্রথম কোনো ভালোবাসার মানুষ, তৃষ্ণাতুর এলিনা ছুটে গেলো ভেক্টরের
বুকে। ভেক্টরের চুপচাপ স্বভাব , অথচ যখন কথা বলে তখন এলিনা অবাক হয়ে শোনে। ভেক্টরের
কথা শুনলে মনে হয়, কেউ যেন মৃদু নাদে চাপা দম্ভে কথা বলছে। ভেক্ট্রর থেকে থেকে এলিনাকে
বলত, Mother Russia shall rise again, and I shall see it, at any cost! এলিনা অবাক
হয়ে ভেক্টরের কথা শুনতো, গর্বে ভরে যেতো তার বুক। অথচ সে গর্বের কারণ আজও অস্পষ্ট।
ভেক্টর কি আদৈও এলিনাকে ভালোবাসতো? এলিনার স্পষ্ট মনে আছে প্রথম একান্তে আসা সে রাতের
কথা। হফম্যান বারে বসে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছিল দুজনে। শিরায়-উপশিরায়
সে রাতে বিয়ারের উত্তাপের চেয়ে মনের উথাল-পাতালের ঢেউ ছিল বেশি। না, মাতাল হয়ে
উত্তাপের আগুনে কেউ ঝাপ দেয়নি, যা হয়েছিল তার সবই সজ্ঞানে । মাদক যদি থাকেই, তবে তা
ছিল দুজনের মনে। তবে কেন?
শুড়িখানার উপর বদ্ধ দুর্গন্ধ ঘরটাতে বসে কপির ঝোলে চুমুক দিলো
এলিনা। আজকাল খুব বমি বমি লাগে, কিছু খেতে গেলেই নাড়ি উল্টে আসতে চায়। ঘন্টা তিনেক
আগের ঘটনা ফের চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো এলিনার। সে ঠিক কাজটাই করেছে, মেয়েটাকে সে মরতে
দিতে পারত না। মেয়েটাও যে তারই মতো, মেয়েটার শরীরেও যে বাজছে একই সাথে দু দুটো হৃদস্পন্দন
!
মেয়েটাকে যখন ধরে আনা হলো তখন সে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র । সরু চিকন
দেহে অস্বাভাবিক উঁচু পেট প্রথমেই চোখে পড়েছিলো এলিনার। বাম পায়ের বুলেট বেঁধার চিহ্ন
, ভাঙা ডান হাত, পিঠ ক্ষতবিক্ষত । জুলি বেকার, হ্যাঁ, মেয়েটার নাম তো জুলিই ছিলো। এতটুকু
মেয়ে, অথচ গুপ্তচর ! এজেন্সির হেডকোয়ার্টার থেকে তখনই মৃত্যু পরোয়ানার নির্দেশ এলো।
রিমান্ডে যেহেতু কিছু পাওয়া যায়নি তাই বাঁচিয়ে রাখাটা সময়ের অপচয় মাত্র । এলিনা কেন
যেন মানতে পারেনি, পারেনি ভেক্টরকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে। দুজন গার্ডকে ধরাশায়ী করে
জুলিকে যখন পালাতে দিল ততক্ষনে তার নামেও হুলিয়া জারি হয়ে গেছে। এলিনা গতো দুদিন ধরে
ছুটছে, মস্কোর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তাকে বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে আরেক সত্ত্বাকে
বাঁচানোর জন্য।
বিকালে স্কয়ারে প্রচুর মানুষের ভীড় হয়। মোটা থামের আড়ালে উকি
দিয়ে পুরো দলটাকে দেখল এলিনা। এজেন্সির মোট সাত জন, সবাই চেনা মুখ, সবার আগে ভেক্টর।
ভেক্টর কি তাকে সত্যি গুলি করবে? সেই নিঃশ্বাসে একাকার হওয়া রাতগুলো, সেই নদীর পাড়ে
হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানো মুহূর্তগুলো, একই কফির কাপে দুজনের ভেজা ঠোটযুগল, সেগুলো
কি ভেক্টরের একদমই মনে নেই ! পরমুহূর্তেই ভেক্টরের কথাগুলো কানে বাজল এলিনার, ‘…At
any cost!’ । হ্যাঁ, ভেক্টর পারবে, সে ক্ষমতা তার আছে। তবু অদ্ভুত এক অলীক আশা বেঁধে আছে এলিনার
মনে, হয়ত ঝর্ণার স্রোতেরও বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হয়!
দৌড়ে গলির
ভিতরে ঢুকল এলিনা, সরু গলিতে কাঠের ভাঙা আসবাব স্তুপ হয়ে আছে। ফাঁকের মধ্যে দিয়েই সরু শরীর গলিয়ে দিল সে।
ভেক্টর তার পিছু নিয়েছে। তাকে
দেখামাত্র স্কয়ারে দুটো গুলি চলেছে, তার মধ্যে একটা গুলি সম্ভবত ভেক্টরেরই করা।
ঢিবি পেরিয়ে হটাত গলির শেষপ্রান্ত
আবিষ্কার করল এলিনা, বন্ধ কানাগলি ! বেরোবার উপায়টুকু নেই! কান্না আসে এলিনার, অসহায়
ভয়ার্ত কান্না। সে কান্নায় হয়ত কিঞ্চিত অভিমানও মেশানো ছিল। ঢিবির ওপাশে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, একজোড়া
পায়ের শব্দ । ভেক্টরের রাফাল শু’য়ের খটখটে এ আওয়াজ চেনে এলিনা। এর সে
কাঁদে না, ভীষণ রাগে বাস্পের মতো ঝরে তার চোখের জল। উরুর ব্যান্ড থেকে পেন গানটা
বের করে এলিনা, দৃষ্টি স্থির সামনের দিকে, পিস্তল উদ্যত।
ঢিপির আড়াল থেকে দৌড়ে ভেক্টর বেরিয়ে আসে। টুইড জ্যাকেটের উপর
স্লিভলেস কোট গায়ে, এলিনার পিছু দৌড়ে সে ক্লান্ত। এলিনার থেকে দশ-বারো হাত দূরে
সে, হটাত চোখ পড়ে এলিনার উপরে। দ্রুত জ্যাকেটের ভিতরে বাম হাত ঢোকায় ভেক্টর।
এলিনার মনের কোনো এক অঞ্চলে বেঁচে থাকা ক্ষীণতম অলীক আশাটুকুর করূণ সমাপ্তি হয়।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে না, পরপর দুবার সজোরে ট্রিগার টানে। বদ্ধ গলিতে বড্ড ভোতা শোনায়
শব্দ। ভেক্টর ছিটকে পেছনে পড়ে যায়, মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে। তারপর , সব শেষ। ভেক্টরের
রক্তে রাস্তার লাল ইট আরো লাল হয়, দাঁত বের করে হাসছে যেন। কম্পিত পায়ে ভেক্টরের
দেহের দিকে এগিয়ে আসে এলিনা। তার আর কান্না পায় না, এক অদ্ভুত বিষাদ গলা পর্যন্ত
এসে আটকে থাকে যেন। ভেক্টরের মুখ আগের মতো শান্ত-সৌম্য, ঠিক যেন বিছানায় ঘুমাচ্ছে।
পেন গানটা হাত থেকে ফেলে দিল এলিনা, গুলি শেষ। ভেক্টরের বাম হাত তখনো জ্যাকেটে ঢোকানো।
সেখানে কি আছে তা এলিনার অনুমান করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। পিস্তলটা নেয়ার
জন্য জ্যাকেটের ভিতরে হাত গলিয়ে দিলো এলিনা। না, ভেক্টরের হাতের মুঠোয় কোনো পিস্তল
ছিল না, যা ছিলো তা পিস্তলের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ভেক্টরের মুঠোয় একটা গোলাপ, রক্তে ভেজা
টকটকে লাল গোলাপ।
Comments
Post a Comment