গল্পঃ মায়া

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

“ ধুর বাবা, তুমি এখনও ওল্ড এজ এতেই পড়ে রইলে। আমার বাচ্চাকে আমাকেই পেটে ধরতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বি এ লিটল বিট সাইন্টিফিক, অন্য উপায়ও আছে। “
মেয়ের এমন কথা শুনে অনেকটা স্তব্ধ হয়েই বসে রইলেন জাফর শেখ। পাশে দাঁড়ান রানার কানেও কথাটা বেশ ভালোভাবে গিয়েছে, কিন্তু এর আগেও এই কথা অন্য সুরে শুনেছে সে। তাই অনেকটা অভ্যস্ততার বশেই খুব একটা চমকায়নি সে, শুধু গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করল। প্রেক্ষাপটটা জানলে ঘটনাটা বোঝা খুব একটা ঝামেলা হবে না।

জাফর শেখ এর একমাত্র মেয়ে লিজা। জন্মের পরপরই মা মারা যায় লিজার। জাফর শেখ অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেকগুলো ফ্যাক্টরির মালিক। এরকম বড়লোকদের ক্ষেত্রে বউ মরলে তারা দ্বিধা না করেই আবার বিয়ে করে বসেন, জাফর শেখ টা করেননি। মা মরা মেয়ের কথা চিন্তা করে তিনি একাকীত্বের ব্রতকেই গ্রহণ করেছেন, প্রাচুর্যের সাগরে সবসময় ভাসিয়ে রেখেছেন নিজের মেয়েকে। প্রাচুর্যের কারণেই হয়ত অহংকার আর তথাকথিত পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকৃত রুপ গ্রহণ করতে লিজার খুব বেশি সময় লাগেনি। রাত আর দিন সমান তার কাছে, দুধের মাছির মত ছেলে বন্ধুরও অভাব নেই। মেয়ের এই উচ্ছুন্নে যাবার বিষয়টা জাফর শেখের চোখে পড়ে কয়েকবছর আগে। নিজেরই অফিসের এক ছেলের সাথে বিয়ে দেন নিজ মেয়েকে। রানাকে দেখলেই বোঝা যায় ছেলেটা ভদ্র, তার উপর অনাথ হওয়ায় কোন পিছুটান নেই। তার আশা ছিল বিয়ের পর মেয়ে ঠিক হয়ে যাবে, হয়েছে তার উল্টো। লিজার উগ্রতা আরও বেড়েছে। রানার কিছুই বলার নেই, ঘরজামাই সে, শ্বশুরের অফিসের চাকরি করছে, এরপর যদি তার মেয়ের উপরেই কথা বলে তবে হিতে বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক।

স্তব্ধতা কাটিয়ে জাফর শেখ গম্ভীর স্বরে বললেন,” মানে? কি বলতে চাও তুমি? বিয়ের বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে, সন্তান নেবার এই শেষ সময়। তোমার বাচ্চা তুমি পেটে ধরবেনা মানে!”
অবশ্য রানার সন্তান লিজার পেটে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চাকরের চেয়ে বেশি মর্যাদা রানা কখনো পায়নি। প্রকৃত অর্থে স্বামী স্ত্রীর মিলন তাদের মধ্যে হয়নি কখনো। শুধু একবার রাতে প্রচুর ড্রিঙ্ক করে ঘোরের বশেই নিজের কাম চরিতার্থে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল লিজা। এমন মিলনে রানার মনে বিতৃষ্ণা জাগলেও লিজার উদ্ধত যৌবনের কাছে তা ফিকে হয়ে গিয়েছিল।

আদুরে মেয়েদের মতো বাবার গলা জড়িয়ে ধরল লিজা, সাথে সাথে জাফর শেখ কড়া এভারক্লিয়ারের গন্ধ পেলেন।
“ তুমি ড্রিঙ্ক করে এসেছ? “ অনেকটা ধমকের স্বরে বললেন জাফর শেখ।
“ আরে এত রাগ করছ কেন বাবা! সজিবের বার্থডে ছিল, সবাই জোরাজুরি করল বলে আর না করতে পারিনি। “
“ রানাকে নিয়ে যাওনি কেন?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি মেয়ের দিকে। মুহূর্তে ধিক করে জ্বলে উঠল লিজার চোখ।
“ ওই ছোটলোকের বাচ্চা গেঁয়ো ভূতটাকে নিয়ে যাব! ওকে নিয়ে গেলে আমার ইমেজের কি হাল হতো বুঝতে পারছ বাবা। “ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রানাকে কোন তোয়াক্কা না করে ঝাঁঝের সাথে বলল কথাগুলো। রানা অবশ্য মোটেও গায়ে মাখল না, এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে।
“ লিজা! রানা তোমার স্বামী। সম্পর্কের হিসেবে অন্তত তার সম্বন্ধে এমন কথা বলা তোমার উচিত নয়।“
“ বলব, একশো বার বলব। তুমি আমার পুরো জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছ এই গেয়ো ভূতটার সাথে। এখন অন্তত আমাকে আমার লাইফটা এনজয় করতে দাও। “

মেয়ের কথা শুনে জাফর শেখের মনে হল তিনি কথা বলার ভাষা হারিয়েছেন। মা মরা মেয়েকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে মানুষ করার এমন ফল হবে তা তিনি কখনো ভাবতে পারেননি। অঙ্ক কষ্টে গলা খাকরে তিনি মূল প্রসঙ্গে ফেরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কথাটা রানার সামনে বলতে তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। তথ্যটা তিনি যার কাছ থেকে পেয়েছেন সে অতি বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু মেয়ের এমন অধঃপতন হতে পারে তা তার কল্পনার বাইরে ছিল। অবশেষে লজ্জা কাটিয়ে বলেই ফেললেন,
“ গত সোমবার হোটেল সোনারগাঁও তে যে ছেলেটার সাথে ছিলে সে ছেলেটার নাম কি?”
জাফর শেখের মুখে এমন কথা শুনে কোন ভাবাবেগ হল না রানার কিন্তু প্রশ্ন শুনে প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেল লিজা, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হটাত আক্রোশে ফেটে পড়ল।
“ তুমি আমার পিছনে স্পাই লাগিয়েছ! তোমার সাহস হল কি...”
“ সেটা বড় কথা নয়, আগে বল ছেলেটা কে।“
কথার খেই হারিয়ে ফেলে আমতা আমতা করতে লাগল লিজা” আমরা শুধু বন্ধু, নিপার বাড়ির পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল।“
এবার রাগে ফেটে পড়লেন জাফর শেখ, “ বন্ধু! একটা নির্জন রুমে একটা ছেলের সাথে টানা পাঁচ ঘণ্টা একসাথে থাকা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নয় লিজা। “

লিজা অপ্রস্তুত হয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, তখনই জাফর শেখ পিছনে থেকে আবার বলে উঠলেন, “ একটা কথা শুনে রাখ লিজা, তুমি যদি সন্তান না নাও তবে আমার সম্পত্তির এক কানাকড়িও তুমি পাবে না এবং অবশ্যই তা হতে হবে রানার সন্তান। “ রানার সন্তান শব্দটার উপর বেশি জোর দিলেন জাফর শেখ।
“ বাবা, বাচ্চা পেটে ধরলে আমার ফিগার পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।“
লিজার কথা শুনে এবার রানাও অবাক না হয়ে পারলো না। মানুষ এমনও হয়!
“ আমি তোমার শর্তে রাজি, তবে আমি অন্য ভাবে সন্তান নেবো। এখন অনেকে টেস্টটিউব বেবি নিচ্ছে। আমার এক বান্ধবি নিপা ও ওই ভাবে বাচ্চা নিয়েছে। এবার খুশি তো?”
খুশি হতে পারলেন না জাফর শেখ “ ওটা বন্ধ্যাদের জন্য, তুমি বন্ধ্যা নও লিজা। “
“ তুমি বাচ্চা নেবার কথা বলেছ আমি তাই এই পদ্ধতির কথা বললাম। এছাড়া অন্য কোনোভাবে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাচ্চা নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। “ দমাদম পা চালিয়ে ঢুলতে ঢুলতে নিজের রুমের দিকে পা চালাল লিজা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাফর শেখ , শেষ বয়সে এসে এমন ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি তিনি হবে তা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রানার দিকে তাকালেন তিনি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন রানা নিঃশব্দে হাসছে। মানুষ শুধু আনন্দে হাসে না, দুঃখও মানুষকে হাসায়, সে হাসিতে প্রাণ থাকে না, থাকে শুধু জীবনের প্রতি একরাশ হতাশা আর অভিমান।

আক্কাস আলি মারা গেছে মাস দুয়েক হল। জয়তুন্নেসা আজও তার অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হতে পারেনি। আজও তার মনে হয় সন্ধাবেলা মানুষটা রিক্সা রেখে বাজার করে বাড়ি ফিরে আসবে। আক্কাস আলি আসে না, তবু সন্ধ্যা বেলা দরজার দিকে চোখ মেলে থাকে জয়তুন্নেসা। রিক্সাসহ ট্রাকের নিচে পুরো পিষে গিয়েছিল আক্কাস আলির দেহ, দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে প্রাণ বের হবার সুযোগটাও পায়নি সে। লাশটা আনা হয়েছিল বস্তিতে, জয়তুন্নেসা চিনতে পারেনি, কারণ এক দলা মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই বোঝার জো ছিল না। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় স্বামী হারা হয়ে নিজ ছেলেকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়ল জয়তুন্নেসা। বয়স তার সবেমাত্র বিশের কোঠায়, উঠতি যৌবনে একটা বস্তিতে ছোট ছেলেকে নিয়ে একা থাকা কতটা ভয়ঙ্কর তা ভাবতেও শিউরে ওঠে সে। প্রতিরাতে মানুষরূপী হায়েনাদের লোলুপ ডাক তার বাড়ির আশেপাশে শোনা যায়, কম্বলের নিচে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জয়তুন্নেসা আক্কাস আলির নির্ভরতার স্পর্শ পেতে চায়, ঠিক সে সময় তার মনে পড়ে মানুষটা আর নেই।

দিন কয়েক হল পাশের একটা ক্লিনিকে জয়তুন্নেসা চাকরি পেয়েছে। আয়ার চাকরি, বেতন নামমাত্র। এত কম বেতনে সংসার চালানো প্রায় দুঃসাধ্য। লালটুর বয়স এবারের ফাল্গুনে পাঁচ এ পরেছে। দুধদাঁত পরা লালটু যখন ফোকলা হাসি দেয়, জয়তুন্নেসার কাছে সেটাই ভাঙা কপালের একটুকরো অক্ষত সুতা মনে হয়। সেদিন বিকালে বস্তির ছেলেদের সাথে খেলতে গিয়েছিল লালটু, বারান্দার চুলোয় বসে রান্না করছিল জয়তুন্নেসা।
“ খালাম্মা, জলদি আইয়েন, লালটু ফিট হইয়া গেছে।“
পুচকে বদির মুখে এমন কথা শুনে প্রথমে স্থাণু হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন জয়তুন্নেসা, বিষয়টা এখনও তার মাথায় ঢোকেনি। যখন বুঝতে পারলেন, তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,” অরে আমার লালটু রে, আল্লা রে আমার লালটুর কি অইল রে!” রান্নাবান্না থুয়ে মাঠের দিকে ছুটলেন জয়তুন্নেসা।তার পিছন পিছন বদি ছুটে আসছে, হাফপ্যান্টটা কখন তার কোমর বেয়ে নেমে গেছে তা সে খেয়াল করেনি।

মোটামুটি একটা জটলা বেঁধে গেছে, চারপাশে উৎসুক বস্তির জনতা। মাঝে জয়তুন্নেসা লালটুকে কোলে নিয়ে বিলাপ করছেন, লালটুর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। শেষ পর্যন্ত জমির চাচার উদ্যোগে লালটুকে হাসপাতালে নেওয়া হল। লালটুর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু পিঠের পিছন দিকে প্রচণ্ড ব্যাথায় সে ককিয়েই যাচ্ছে। জয়তুন্নেসার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু বইছে, ছেলেকে মাঝে মাঝে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে সে।

ড আকরাম তার চেম্বারে বসে আছেন। প্রচণ্ড বিরক্ত তিনি, সেই বিরক্তি তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও যে তিনি ঢাকতে পারছেন না তা তার মুখ দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। তবু তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন মুখে হাসি ধরে রাখতে কারণ তিনি এখন মোটামুটি প্রভাবশালী একজনের সামনে বসে আছেন। জাফর শেখ বান মাছের মতো বাঁকা হয়ে কোঁচকাচ্ছেন। জাফর শেখকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের অতি সম্প্রতি পাইলসের অপারেশন হয়েছে, ঘা টা এখনও শুকায়নি, সে কারণে চেয়ারে বসে এত দুলাদুলি করছেন। পাশে রানাও খানিকটা বিরক্ত চোখে চেয়ে আছে।
“ দেখুন স্যার, টেস্ট টিউব বেবির জন্য কিছুটা ঝক্কি তো পোহাতেই হবে। তবে এখানে আপনার মেয়েকে নিয়ে আসা উচিত ছিল। উনার ফিজিক্যাল কন্ডিশন কেমন টা একবার চেকাআপ করাতে হবে। “
ডাক্তারের কথা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল জাফর শেখের। লিজা আসতে পারেনি, সে খুব ব্যস্ত, এক বন্ধুর বাসায় মিডনাইট পার্টি আছে , সেখানে তাকে থাকতেই হবে।
“ ডক্টর, কোন ঝামেলার কথা বলছিলেন যেন?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, আসলে মূল ঝামেলা হয় Host মাদার খুঁজতে গিয়ে। এখন যা অবস্থা তাতে দরিদ্র অঞ্চলের মহিলাদের কেই এই কাজে রাজি করানো যাবে। কনসিভ করার পর এদেরকে কোথায় রাখবেন টা নিয়েও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। “
“ তো এসব কি আমরা খুজব নাকি! হাসপাতাল এরই তো সব ব্যবস্থা করার কথা। “ অনেকটা ঝাঝাল স্বরে বললেন জাফর শেখ। জাফর শেখের ধমক খেয়ে নুন পড়া জোঁকের মতো কুঁচকে গেল আকবর।
রানা এবার ভদ্রভাবে বলল,” তো ডক্টর, আমাদের করণীয় কি?”
“ আপনারা দুজনে কি করবেন! আপনাদের শুক্রাণুর মিলনে বাচ্চা হবে নাকি!” খোঁচা মারার সুযোগটা ঠিকমতই কাজে লাগিয়েছিলেন ড আকবর, কিন্তু পরক্ষনে বুঝতে পারলেন ভুল হয়ে গেছে তার, মহা ভুল। জাফর শেখ চেয়ার ছেড়ে তেড়ে উঠলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে চেম্বারে নার্সের আগমনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আকবর।
“ স্যার, জরুরি বিভাগে একটা রুগি এসেছে, বাচ্চা ছেলে। “
ধড়ে যেন জান ফিরে পেলেন ড আকবর, “ হ্যাঁ চলুন চলুন। স্যার, কিছু খাবেন? কফি দিতে…” জাফর শেখের রক্ত চক্ষু দেখে আর কথা বাড়াবার সাহস পেলেন না তিনি, দ্রুত পা চালিয়ে জরুরি বিভাগের দিকে রওনা দিলেন তিনি। যখন চেম্বারে ফিরলেন, তার মুখ তখন আনন্দে চিকমিক করছে।
“ স্যার, একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল।“ ডাক্তারের এমন আকস্মিক পরিবর্তনে বেশ অবাক হল রানা।
“ কি বলতে চাচ্ছেন স্পষ্ট করে বলুন, গালের ভিতর অর্ধেক কথা রাখবেন না। “
“ স্যার, খুব একটা ভাল সুযোগ এসেছে। সুযোগের ব্যবহার করাটাই হবে বুদ্ধিমানের….”
“ এই সালা আকবরের বাচ্চা, কি কইল শুনিস নি?” দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কথাগুলো বললেন জাফর শেখ।
“ জি স্যার, আই বেগ ইওর পারডন। এক রোগী এসেছে, বাচ্চা ছেলে। কিডনি দুটোর একটা পুরো ড্যামেজ হয়ে গেছে। “
“ তুই কাছে আয়, তোর কান দুটো দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব।“
“ স্যার শুনুন না প্লিজ। ছেলের মার সামর্থ্য নেই অপারেশনের টাকা যোগান দেয়ার। আপনি যদি এ সামান্য কটা টাকা দিতে পারেন তবে ওই মহিলা Host মাদার হতে বাধ্য। মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভাল, বয়স বোধহয় বিশও হয়নি। “

ড আকবরের কথা শুনে এবার হুশ ফিরল জাফর শেখের , সেই সাথে ডুগডুগি বাজানোর ইচ্ছাটাও বিদায় নিল। ড আকবরের সাথে ওয়ার্ডের দিকে চললেন তিনি।
জয়তুন্নেসা চুপ করে আছে। ডাক্তারের মুখে প্রস্তাব শোনার পরও কিছু বলতে পারছে না সে, বাস্তবতার কাছে সে হাড় মেনে গেছে।
“ দেখেন, আপনি যদি কাজটা করেন তবে আপনার ছেলেও বাঁচল, তারাও সন্তান পেল। আপনি বুঝতে পারছেন কি বলতে চাচ্ছি?”
মোহাবিষ্টের মতো মাথা নাড়ায় জয়তুন্নেসা। বিষয়টা এখনও সে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিকমতো।
“ কিন্তু, আমার সোয়ামি মরছে আজক্যা মাস দুই অইল, এহন আমি পোয়াতি অইলে মানসে নানা কতা কইব। আমি মুখ দেহামু কনহানে।“
“ আপনাকে এই সময় আমরা একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্রে রাখব, আপনার ছেলের অপারেশনের পর সেও আপনার সাথে ওখানে থাকবে। তাছাড়া আমরা কিছু টাকার ব্যাবস্থা করব। “ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে রানা।“ আপনি কি রাজি?”
অনিচ্ছার সত্ত্বেও মাথা কাত করে জয়তুন্নেসা জানায় সে রাজি।

বেশ কয়েকদিন বাদে জয়তুন্নেসার জরায়ুতে গ্যামেট স্থানান্তর করা হল। লিজা ব্যাপারটা নিয়ে মহা বিরক্ত, একটা আর্ট ফেস্টিভ্যালে রাজিবের সাথে ডেট ছিল তার। রাজিব তাকে তার নতুন ফ্লাটটাও দেখাবে বলেছিল, বাবার চক্করে কিছুই হল না। জয়তুন্নেসাকে একটা প্রাইভেট আশ্রয়ণ কেন্দ্রে রাখা হল। লালটুর অপারেশন হয়েছে। তাকেও শর্ত মোতাবেক জয়তুন্নেসার সাথে রাখা হয়েছে।
৮ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। জয়তুন্নেসার স্ফিত উদর তার ভিতরে থাকা নতুন প্রানের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
“ মা, দেহিস, আমার একখান ভাই অইব। তার লগে আমি সারাদিন খেল্মু।“
লালটুর কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ে থাকে জয়তুন্নেসা। পেটের উপর হাত বুলিয়ে ভিতরের অস্তিত্বকে অনুভব করার চেষ্টা করে। কয়েক মাসে এ অস্তিত্বের টানে পড়ে গেছে সে, এ কথা সে জানলেও মানতে চায় না।
“ ও মা, কতা কস না ক্যান? আমার ভায়ের নাম কি রাহুম?”
জয়তুন্নেসা কথা বলে না, নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে লালটুর দিকে। লালটু একটানা বলতে থাকে সে কি করবে তার ভায়ের সাথে। জয়তুন্নেসা নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে ফেলে।
লেবার পেইন উঠেছে জয়তুন্নেসার, অপারেশন থিয়েটারে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে রানা , জাফর শেখ আর লিজা দাঁড়িয়ে আছে। এক কোণে লালটু দাঁড়িয়ে আছে, কাঁদছে সে। আজ সকালে কি হল সে জানে না, তার মা হটাত ব্যাথায় কোঁকাতে শুরু করেছিল। লিজা বারবার ঘড়ি দেখছে।
“ বাবা, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তুমি বুঝতে……” জাফর শেখকে ভয়ঙ্করভাবে তাকাতে দেখে থেমে যায় লিজা। রানা নিজের মনেই দোয়া দরুদ আওরাচ্ছে। ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। জাফর শেখ হুড়মুড় করে উঠে বসেন। নার্সের কোলে এক ছোট্ট দেব শিশুকে আনতে দেখা যায়।
“ স্যার, আমদের মিষ্টি খাওয়ান, ছেলে হয়েছে। “
দ্রুত বাচ্চাকে কোলে নেন জাফর শেখ,” দেখ লিজা, কি সুন্দর বাচ্চা হয়েছে তোর, নে, কোলে না।“
“ দেখ বাবা, সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা কর, শাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে, এখন কোলে টোলে নিতে পারব না।“

দূর থেকে বাচ্চাকে দেখছিল লালটু, এই তাহলে তার ভাই! অবাক হয় সে। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ছুঁয়ে দেখবার সাহস হয় না। অথচ কদিন আগে জয়তুন্নেসা তাকে বলেছিল যে ভাইকে সেই প্রথম কোলে নেবে।
“ আমারে একটু দিবেন? একবার কোলে নিমু।“
লালটুর কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকান জাফর শেখ ,” দূর হ হতভাগা।“
জাফর শেখের এমন আচরণে অবাক হয়ে যায় লালটু।গলার ভিতর মনে হয় কিছু একটা দলা বেঁধে আছে তার। চোখের জল গড়িয়ে পরতেও দেরি লাগেনি, কিন্তু সে ক্ষুদ্র সত্তার চোখের জলে কারো কিছু আসে যায় না।

জ্ঞান ফিরেছে জয়তুন্নেসার। জ্ঞান ফিরেই একটা চিরচেনা অস্তিত্বের অনুপস্থিতি অনুভব করল সে।
“ ও ডাক্তার সাব, আমার বাচ্চা? আমার বাচ্চা কই?”
এমন প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলেন ডাক্তার,” আপনার বাচ্চা মানে? বাচ্চা আপনার ছিল কবে? যাদের বাচ্চা তারা নিয়ে গেছে। আপনি আগামিকাল বেড ছেড়ে দেবেন।“
“ একবার, শুধু একবার দেহুম। ও ডাক্তার সাব……”
“ আরে, মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি! তাদের বাচ্চা আপনি দেখে কি করবেন!”
আড়ষ্ট হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল জয়তুন্নেসা, নিজের একটা অস্তিত্ব হারানোর শোকে সে দিশেহারা। তখন পাশে খেয়াল করে সে দেখল লালটুও কাঁদছে। জয়তুন্নেসা লালটুকে বুকে জড়িয়ে ধরল। অস্তিত্বহীন এক সত্ত্বার অনুপস্থিতিতে জননীর বুকে এক ক্ষুদ্র সত্ত্বা কাঁদছে। নিষ্ঠুর পৃথিবী তাদের বড্ড অসহায় করে দিয়েছে।
( সমাপ্ত)
                          

Comments

Popular posts from this blog