বিষয়ঃ বাবার গান

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন 

( ভিডিও দেয়া হবে অতি শীঘ্রি)

আমার বাবা মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব কাজকর্ম করেন। সেসব দেখে মাঝে মাঝে আমি চুপচাপ থেকে হাই তোলার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। এই তো কদিন আগেকার ঘটনা। বাবার হটাত করে খেয়াল হল তার ভূড়ি নামছে। একেবারে গোলগাল পটবেলি যাকে বলে ঠিক তা নয়, নোয়াপতি ভূড়ি বলা চলে। এমন ভূড়ি দেখতেই মন ভালো হয়ে যাবার কথা, পেট শুরু হতেই ছোটখাট সাইজের টিলার মতো, দেখলেই মনে হয় টিপে দেই । প্রায় পয়তাল্লিশঊর্ধ্ব একজন মানুষের ভুড়ি নামাটা খুব একটা ভাবনার বিষয় না, আমার তো ১৮ তে পৌছানোর আগেই নেমে গেছে। কিন্তু বাবা ভাবনায় পড়ে গেলেন। সপ্তাহভর নানরুটি আর শিক কাবাব খেতে খেতে তিনি প্লান করলেন যে খুব ভোরে তাকে হাটতে বের হতে হবে, রাতে রুটি খেতে হবে, গ্রিন টি খেতে হবে, তবেই মুক্তি। প্লান মোতাবেক সেদিন রাতে খাসির মাংস দিয়ে দু প্লেট ভাত সাবড়ানোর পর তিনি ৬-৭ খানা রুটি খেয়ে মৃদু হেসে ভূড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন, এবার দেখা যাবে ভূড়ি বাবাজি কি করে বাড়ে! পরদিন সকালে তাকে টেনে তোলা হল। বাবা বুক ডন দেয়া শুরু করলেন এবং প্রকান্ড ভূড়ির বদৌলতে অনতিবিলম্বে তা ‘বেলি ডাউন’ ব্যায়ামে পরিণত হল। জগিং এর জন্য হাতে পায়ে রবারের ব্যান্ড লাগিয়ে দিয়ে মৃদু চালে হেটে বাইরে গেলেও ফিরলেন অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম পাশের বাড়ির সেলিম সাহেবের কুকুর বাবাকে তাড়া করেছিলো। বাবার সকল অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডই তাই এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আজ সকালে সবে পত্রিকাটা খুলে বসেছি ঠিক সে মুহূর্তে বাবা এসে ঘোষণা করলেন যে বাবা স্টেজে উঠে গান গাইবেন। পরমানন্দে চায়ে চুমুক দেয়ার মুহূর্তে এই অদ্ভুতুড়ে কথা শুনে বেশ বড় ধরনের বিষম খেলাম। অদ্ভুতুড়ে বলার যথেষ্ট কারণ আছে। বাবা শিক্ষক মানুষ, সরকারি কলেজের প্রফেসর। ছাত্রদের যখন পড়ান তখন গলার স্বর শুনে মনে হয় মোটামুটি সাইজের পেল্লাই একখানা মেঘ ডাকছে। গান গাইলে যে কি হবে আল্লাহ মাবুদই জানে। এমন অদ্ভুত শখের কারণ কি! তখনই মূল ব্যাপার জানা গেল। কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান, সেখানে শিল্পী সংকট। তাই শেষ পর্যন্ত বাবাকে ধরা হয়েছে। অন্যবারের মতো এবারেও হাই তুলে বিষয়টাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম, মোল্লার দৌড় যে মসজিদ পর্যন্ত তা বেশ জানা আছে। কিন্তু সেদিন রাত্রেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে বাবা রীতিমতো হারমোনিয়াম নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাত গভীর হয় আর তার সাথে বাড়ে বাবার হেড়ে গলার চিৎকার। সাথে অনভ্যস্ত হাতে বাজানো হারমোনিয়ামের প্যা প্যু শব্দ। পরদিন সকালবেলা। ডাইনিং টেবিলে আমরা দু ভাই শঙ্কিত চোখে বাবার তাকিয়ে আছি। বাবার মুখ হাসি হাসি, কোলের উপরে হারমোনিয়াম রেখে তিনি একের পর এক পরোটার গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত। খাওয়া শেষ করে তিনি হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকালেন, জিভখানা বারদুয়েক বের করলেন, নাক উচু করে শ্বাস নিলেন, তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন, “ গান গাওয়া যতটা কঠিন মনে করেছিলাম ততটা কঠিন না” তার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ আমাদের বোঝা হয়ে গেলো, গান তিনি গাইবেনই।
আমার সামনে ভিডিওটা চলছে। ভিডিওতে যিনি গান গাইছেন তিনি নিঃসন্দেহে আমার বাবা। বাবা মনে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন, কিন্তু সুরটা শোনা যাচ্ছে আসিফের ‘ ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এর মতো। আমি মনে মনে বলছি, ধরণী দ্বিধা হও, আমি তোমার মাঝে সেধিয়ে যাই। চারদিকে সবাই হাসছে, মাথা নেড়ে হাসছে, ভ্রু তুলে হাসছে, ঠ্যাঙ ছড়িয়ে হাসছে, কয়েক বছর ব্রাশের আচড় না পড়া দাঁত বের করে হাসছ,ভূড়ি নাচিয়ে হাসছে। এমনকি ভিডিওর প্রবল নড়াচড়া দেখে বোঝা গেলো যে ক্যামেরাম্যানও হাসছে। বাবা কিন্তু তার নোয়াপোতি টিলামার্কা ভূড়ি দুলিয়ে হাসিমুখে গেয়েই চলেছেন—
“ ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়!!”
                                 

Comments

Popular posts from this blog