টিউশনি

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

এস এস সি শেষ হওয়া মাত্র আমার মাথায় ভূত চাপল, টিউশনি করাব। অনেকে শুনেছি এস এস সি এর পরপরই টিউশনি করায়, আমি করালে কি দোষ! কার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে শুনি? বাড়িতে গিয়ে বলতেই বাবা নির্লিপ্ত স্বরে বললেন- তোমায় আমি খেতে দিই না? আমি যতদূর ঘাড় ঘুরানো যায় ততদুর ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম- জি জি, অবশ্যই। সবই আপনার মেহেরবান। তারপর তিনি বললেন- তোমার হাতখরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে, সম্প্রতি নারী সঙ্গী জুটেছে নাকি? আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলাম যে স্থান তাগ করাই শ্রেয়, নয়লে সামনে ঘোর অমাবস্যা আছে। টুপ করে সরে গেলাম। মায়ের হাতে পায়ে ধরে শেষে মা রাজি হলেন। তিনি অতি উৎসাহী হয়ে বললেন- তোর ছোট ভাইকে পড়া। মাসে ২০০০ টাকা দেব। ছোট ভাই এর দিকে তাকাতেই সে আমার দিকে চোখ মারল। যার অর্থ, আয়, পড়াবি? তোর পড়ান আমি বের করছি। আমি ঢোক গিলে রাজি হয়ে গেলাম, ২০০০ টাকার মায়া সহজে ছাড়া যায় না।এদিকে আমাদের এক ভাড়াটের ছেলে ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। সেও নাকি পড়তে চাচ্ছে। এ তো চা না চাইতেই কফি। আমি তো বাক বাকুম পায়রা। দুজনকে পড়াতে বসেছি। বেশ অস্বস্তি তে আছি, কারণ অভিভাবক আমার দিকে একেবারে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি সামান্য হাসার চেষ্টা করলাম, তাতে আমার ছাত্রের চোখ সরু হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে এয়ারকুলার এ ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি মাত্র সাহারাতে পিকনিক করতে এসেছি। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। পাশে আমার ভাই নির্লিপ্ত ভাবে চুইংগাম চিবুচ্ছে। হটাত আমার এক শিক্ষক এর কথা মনে পড়ল। উনি বিশৃঙ্খলা দেখলেই এমন চিৎকার দিতেন যে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হত। উনাকে স্মরণ করে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম- ওই! বই বের কর। চড়িয়ে দাঁত গিলিয়ে দেব! ফলাফল এমন হবে আশা করিনি। পাশের অভিভাবক হটাত আমার চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠলেন। সামনের ছাত্রের চোখ গুনি ময়রার ৪০ টাকার রসগোল্লার মত হয়ে গেল, আমার ছোট ভাই ক্যোঁৎ করে চুইংগাম গিলে ফেলল, এই হল সামগ্রিক ফলাফল। যাইহোক, ছাত্র তার বই বের করল। আমি বইয়ের দিকে নজর দিলাম। পড়ে গেলাম মহা ফাঁপরে। বাঞ্জন বর্ণ ক থেকে শেষ পর্যন্ত গোনার সামর্থ্য আমার নেই, সেখানে বাংলা দিয়েই শুরু করলাম। প্রথম শব্দ, নয়দুয়ারি । ছাত্র আমাকে মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞাসা করল-ভায়া, নয়দুয়ারি মানে কি? আমার মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল, নয়দুয়ারি! যে ঘরের নয় দরজা আছে? এমন বিশ্রী ঘরের নকশা করেছে কে? নয় দরজার জ্বালা সেই আহাম্মক জানে? প্রতি রাতে নয় দরজায় তালা মারতে হবে, নয়লে নির্ঘাত চুরি । আমি এত ভাবছি দেখে ছাত্র হাসছে। আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললাম- তুই তখন ভাইয়া বললে কাকে? আমি তোর শিক্ষক। আমার রাম তাড়া খেয়ে সে মিইয়ে গেল। এবার গনিতের পালা। একটা অংকও মাথায় ঢুকছে না, ব্যাপার কি! অবশেষে বললাম, বইতে ভুল আছে রে ব্যাটা। ছাত্র আমার কয়, স্যার, ভুল নাই, আমি গাইড দেখেছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম- কি! তুই গাইড পরিস!! তোর সাহস কত বড়! তুই জানিস গাইডবুক আমাদের জাতির কত বড় ক্ষতি করে! তাকে আধাঘণ্টা ধরে বোঝালাম, কেন গাইড ক্ষতিকর। আমার সময় প্রায় শেষ। আমি বললাম- আজকের মত থাক। সে আমার দিকে ইংরেজি বই এগিয়ে দিতেই আমি আঁতকে উঠলাম। আমি যে ইংরেজি তে কাঁচা তা কোনোভাবেই বুঝতে দেয়া যাবে না, বুঝলেই হাটে হাড়ি ভেঙ্গে যাবে। বাইরে শিষ দিতে দিতে বেরিয়ে আসলাম। একদিন যখন কেটেছে, বাকি দিনগুলোও কেটে যাবে।
এখন আমার প্রশ্ন- বাংলাদেশের প্রাইভেট কোচিংগুলোর অবস্থা এর চেয়ে আর কতটুকুই বা ভাল? আমরা যে কোচিং এ আমাদের সন্তান কে দিয়ে মহা নিশ্চিন্তে থাকি, সেই নিশ্চিন্তে থাকবার অধিকার কি আমাদের আছে?

Comments

Popular posts from this blog