গল্পঃ অব্যক্ত

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

দুহাতে মাথা চেপে ধরে মড়ার মতো বিছানায় পড়ে আছে রানা, যদিও মাঝে মাঝে তার চাপা গোঙানি শোনা যাচ্ছে। আমজাদ সাহেবের দুই তলার এই চিলেকোঠায় তার খোঁজ নেয়ার জন্য যদিও কারও আসার কথা না, মেহেবুবা অনেকবার এসেছিলো। দরজায় নাম ধরে ডেকে ধাক্কা দিলেও সাড়া দেয়নি রানা, বিছানা থেকে ওঠার শক্তি তার নেই। নিজে নিজে খুব একটা বুঝতে না পারলেও কাঁপুনি দেখে অনুমান করতে পারছে গায়ে তার অনেক জ্বর। গতকাল রাতে ছাদের ঠাণ্ডা বাতাসে দাড়িয়ে থাকা কতখানি বোকামি হয়েছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে, যদিও এতে তার হাত ছিল না।
ঠিক সে সময় দরজার ওপাশে আমজাদ সাহেবের গম্ভীর গলা শোনা গেল। আমজাদ সাহেবের ডাক অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে বলে রানার মনে হল না। বিছানা ছেড়ে উঠতে গেল ঠিকই কিন্তু ফের ধপ করে পড়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য সব চুপচাপ, তারপর হটাত দরজা ভাঙার শব্দ কানে আসলো। রানার খুব বেশি কিছু মনে নেই, শুধু এটুকু মনে আছে কে যেন পরম মমতায় রানার মাথাটা কোলে তুলে নিল। জ্ঞান হারানোর আগে একবার অস্পষ্টভাবে তার মুখ রানা দেখেছিল , মেহেবুবা কাঁদছে।

বিপত্নীক আমজাদ সাহেবকে দেখলে মনে হওয়ার কোন কারন নেই যে তিনি একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ। কারন আজও তিনি চোখে দিব্যি স্পষ্ট দেখতে পান, মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটেন, রোজ সকালে নিয়ম করে দৌড়ান। তাই কেউ যদি হটাত শোনে যে তার বর্তমান বয়স সাতষট্টি চলছে, তবে নির্ঘাত ভিরমি খাবে। হয়ত আর্মিতে ছিলেন বলেই আজও এমন আছেন। ভদ্রলোককে দেখলে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর মনে হয় অথচ রানা আজ অব্দি এটা ভেবে পায় না যে ভদ্রলোক তাকে এভাবে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিলেন কেন। কংক্রিটের শহরের কারও মনে অযান্ত্রিকতা আজকাল ভাবাই দায়।
ঘটনা নিতান্ত সাধারণ যদিও তাতে সামান্য অসাধারণতার ছোঁয়া আছে। গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে আসা রানা ,মায়ের মৃত্যুর পর বাবার সাথে সামান্য কটা টাকা ছাড়া আর অন্য সম্পর্ক ছিল না রানার। গ্রামের মজিদ ভায়ের কাছ থেকে যে মেসের ঠিকানা এনেছিল সেখানে জায়গা জোটেনি, মেসের মালিক বাম হাতে সর্দি ঝেড়ে লুঙ্গির কোণায় মুছতে মুছতে বলেছিল, ‘না বাপু, জায়গা হবে না, রাস্তা মাপ।‘ শেষে যখন কোন জায়গা না পেয়ে রানা গাবতলি বাসস্ট্যান্ডে রাত কাটানোর চিন্তা করছিল তখনই ঘটনাটা ঘটল। আমজাদ সাহেব পেনশনের টাকা তুলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হটাত দুই হিরুঞ্চি এসে তার উপর জুড়ে বসলো, যাকে কিনা আরও ভালোভাবে বলা যায় ছিনতাই করার চেষ্টা অপচেষ্টা। রানা বিষয়টা দেখে অন্যদের মত না দেখার ভান করে থাকতে পারেনি। এক ছিনতাইকারীর পায়ের নিচে বেশ লম্বা একখানা পলেথিন ছিল, সেটা ধরে টান দিতেই সে জন ফ্লোরে পড়ে নাকমুখ ভেঙে বিশ্রী অবস্থা। অন্যজন বোধহয় তখনো নেশার ঘোরে ছিল, সঙ্গির সেই অবস্থা দেখে সে তৎক্ষণাৎ আমজাদ সাহেবের ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে দু হাত উপরে তুলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘ আই আল্লার কসম কচ্চি, কিচু করি নাই,শুধু ব্যাগের কালার ডা দিকবার ল্যাইগা নিচিলাম।’ তারপরেই রানাকে বাড়ি আনেন আমজাদ সাহেব, দুই তলার স্টোর রুমটাতে রানার থাকার ব্যবস্থা হয়, নিজের দুই মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব দেন। মেহেরুন আর মেহেবুবা। মেহেরুন এবার এস এস সি দিয়েছে আর মেহেবুবা ইন্টারমিডিয়েট দেবে। আমজাদ সাহেব মাঝে মাঝে রানার সাথে পরিচয়ের ঘটনা মেয়েদের বলেন, মেয়েরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড় হয়, আমজাদ সাহেব হাসেন না, ভ্রু কুঁচকে হাসি থামার অপেক্ষা করেন।

চোখ খোলার পর চারদিক একটু অপরিচিত মনে হল রানার, এটা তো স্টোর রুম নয়! রানা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ঘুমিয়ে পরার আগে তো এখানে সে ছিল না। হটাত মেহেবুবাকে দেখে দ্বিতীয়বার চমকে উঠলো রানা, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রানাকে উঠতে দেখেই দৌড়ে আসলো সে।
‘ রানা ভাই, আমাকে মাফ করে দেন, বিশ্বাস করেন, আমি ইচ্ছে করে কাল রাতে ওই কাজ করিনি। আমি কখনো ভাবিনি এমন হবে। যদি জানতাম...... বিশ্বাস করেন।’ কাঁদতে কাঁদতে রানাকে এমনভাবে মেহেবুবা কথাগুলো বলল যেন রানার বিশ্বাসে অনেক কিছু আসে যায়। রানার বেশ কদিন ধরে এই বিষয়গুলো ভাল ঠেকছে না। মেহেবুবা মেয়েটা কয়েকদিন তার সাথে অসংলগ্ন আচরণ করছে। এই তো সেদিন, আমজাদ সাহেবের বাড়ির সামনের বেলি ফুলের গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বেলিফুল দেখছিল রানা, ঢাকা শহরে ফুলের দোকান ছাড়া বেলি ফুল দেখাই যায়না। রানার মুগ্ধ দৃষ্টি মেহেবুবার চোখ এড়ায়নি। তাইতো পরের দিন রানার কাছে খোপায় বেলি ফুলের মালা গুঁজে পড়তে এসেছিল সে। মালাটা রানারও নজর এড়ায়নি, পড়া শেষে শেষে মালাটা খুলে রানার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল মেহেবুবা,রানা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, না বলার সুযোগই সে পায়নি। কদিন আগে টাকার বড় একটা সংকটে ছিল রানা। সৎ মায়ের প্ররোচনায় পড়ে বাবা ২ মাস টাকা পাঠাননি ,এদিকে তার হাতখরচ শূন্যের কোঠায়। সেদিন পড়ানোর পর হটাত মেহেবুবা রানার হাতে দু হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ভাইয়া, বাবা দিয়েছেন। মেহেবুবার কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহেরুন্নেসা বলেই ফেলেছিল, বুবু, এটা তোর জমানো টাকা না? মেহেবুবা ধরা পড়া চোরের মতো যেন পালিয়ে বেঁচেছিল সেদিন। টাকাগুলো ফেরত দিতে পারেনি রানা, টাকার বড়ই প্রয়োজন ছিল তার।পড়ানোর সময় মেহবুবার তির্যক দৃষ্টিও আজকাল রানাকে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলছে। কিন্তু গতকাল রাত্রের ঘটনাটা একটু বেশি বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। গতকাল ছিল শুক্লাদ্বাদশীর ভরা পূর্ণিমা। জোছনার সে অমোঘ ডাক রানা অগ্রাহ্য করতে পারনি, তীব্র শীতেও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝেই এমনটা হয়, কাল রাত্রে এর ব্যাতিক্রম হল মেহবুবার হটাত উপস্থিতির কারণে। মেহবুবা হটাত রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, দুই নিশ্চুপ সত্তা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একে অন্যের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন অথচ বোবা প্রকৃতির মতই নিশ্চুপ। শেষ পর্যন্ত রানা নীরবতার অবসান না ঘটিয়েই ফেরার জন্য হাঁটা ধরেছিল, সেখানেই বাঁধল মূল ঝামেলা। মেহবুবা হটাত রানার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ‘ আপনি আমাকে পছন্দ করেননা, তাই না রানা ভাই?’ মেহবুবার কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রানা, এত দ্রুত সম্মুখ আক্রমণ সে আশা করেনি। ‘ তোমার এখন নিচে যাওয়া উচিত মেহবুবা’ যথাসম্ভব উত্তেজনা চাপা দিয়ে কথাগুলো বলেছিল রানা, কিন্তু এর ফল তার কল্পনাতিক ছিল। ‘ আমার বাড়িতে আমি কোথায় কখন থাকব না থাকব তা আপনাকে হিসাব করতে হবে’ অহমিকায় জ্বলতে জ্বলতে কথাগুলো বলেই ফেলেছিল মেহবুবা।‘ আজ সারা রাত আপনি ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবেন, অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর এই শাস্তি।‘ কথাগুলো বলেই ছাদের দরজা দিয়ে চলে গিয়েছিলো সে, রানা ঠায় দাঁড়িয়েছিল, সে ভাবতেও পারেনি ঘটনা এমন হতে পারে। তীব্র কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভোররাতে রানা বুঝতে পারলো, ছাদের দরজা আসলে লাগানো হয়নি, মেহবুবা খোলাই রেখেছিলো, কিন্তু ততক্ষনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে।

আমজাদ সাহেবকে চিন্তিত মুখে রানার বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখা গেল। রানা খেয়াল করে দেখল ভদ্রলোকের মুখ কেমন শুকনা শুকনা দেখাচ্ছে। রানার সাথে তার খুব বেশি কথা হয় না। দেখা হলেই তিনি – মেয়েদের পড়ালেখা কেমন চলছে আর তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে, এ দুটো প্রশ্ন করে চলে যান। রানার দিকে তাকিয়ে তিনি সান্ত্বনার ভাষায় বললেন,’ এ সময়ে কি অসুখ বাঁধালে বল দেখি! সামনে মেহবুবার বিয়ে, আর এ সময়…’ মেহবুবার বিয়ে শুনেই রানার বুক ধক করে উঠল, অথচে নিজেও জানে না হটাত এ অনুভুতির উৎস কি। ‘ মেহবুবার বিয়ে? জানতাম না তো!’ কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কথাগুলো বলার চেষ্টা করল রানা। ‘ বলেনি? মেহেরুনও বলেনি? বুঝলে রানা, ছেলেটা ভাল। মা নেই অবশ্য, মেয়েটা কোনোদিন মায়ের আদর পেল না। তবে ছেলেটা অনেক ভাল, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।‘ আমজাদ সাহেব নিজের মনেই হাসছেন, পরিতৃপ্তির হাসি। রানা মনোযোগ আমজাদ সাহেবের হাসি দেখছে, হাসলে যে উনাকে এত সুন্দর দেখায় তা সে আগে বুঝতে পারেনি।

মেহবুবার বিয়ে হচ্ছে, চারদিক লোক গিজগিজ করছে। সেই ঘটনার পর মেহবুবা আর পড়তে আসেনি, মেহেরুন অনেকবার জোর করেও আনতে পারেনি। মেহবুবার বিয়ের কথা শোনার পর থেকে রানার মনে কিছু একটা প্রতি মুহূর্তে খচখচ করছে, রানা বুঝতে পারছে না এমন হবার কারণটা কি। কোন কিছুতে তার মন বসছে না, মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা তাঁর ছিঁড়ে গেছে। বাড়িতে অনেক আগেই আত্মীয়স্বজন এসেছে, জায়গার সংকুলান না হওয়ায় রানার স্টোররুমটাতেও আরেকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেইদিন থেকে লোকটা থাকা শুরু করেছে সেইদিন থেকে রানার ঘুম হারাম। একই বিছানায় ঘুমাতে হয়, উনি দু হাত উঁচু করে ঘুমান। উনার বগল থেকে তীব্র বোটকা গন্ধ যে কারো রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। রানারা মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হয়, ভাই, আপনি লাইফবয় সাবান দিয়ে গা ডলে আসেন, আপনার গায়ে হেবি গন্ধ। বলতে পারে না, আশ্রয়টা নষ্ট হবে তাতে। বিয়ে যাবতীয় কাজ তাকেই সামলাতে হচ্ছে। বরপক্ষ আসার কিছুক্ষণ আগে মেহেরুন এসে রানার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেল, মেহবুবার চিঠি।
ভেজা চিঠিটা হাতে নিয়েই রানা বুঝতে পারলো সামান্য কটা কথা লিখতে গিয়ে কত অশ্রুফোঁটা ঝরেছে! চিঠিটা খুলল সে, সম্বোধনহীন চিঠিটাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা, চোখের জলে কালি লেপটে গেছে-
মানুষের জীবন একটা নাকি অসংখ্য আমি জানিনা। তবে আপনার মতো হৃদয়হীনের জন্য আমার জীবনটা আমি নষ্ট করব না।

চিঠিটা পড়ে হেসে ফেলল রানা। কি সরল ভাষা, অথচ কত অব্যক্ত যন্ত্রণার জলছাপ মিশে আছে এই দুই লাইনে!মেহেবুবা কখনো জানবে না যে তার দেয়া বেলি ফুলের মালাটা আজও শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে বইয়ের ভাঁজে যত্ন করে রাখা আছে, জানবে না তার দেয়া টাকাটা দিয়ে কেউ একজন চুড়ি কিনেছিল, কাচের চুড়ি, যাতে দুহাত ভরে দেয়া যায়। মানুষের মনের অজান্তে কত কথাই না থেকে যায়! কন্যা বিদায়ের সময় রানা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল, মেহবুবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস তার হয়ে ওঠেনি।

আজও জোছনা, ভরা জোছনা।রানা একলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। মেহবুবাকে পেছন দিকে আসতে দেখা গেল। ‘ আমার ফুল?! আমার ফুল কই?’ যেন অভিমানের স্বরেই কথাগুলো বলল মেহবুবা। রানা হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো, সেখানে ধরা একগুচ্ছ রাধাচূড়া ফুল। কে বলেছে প্রকৃতি অনিয়ম সহ্য করে না? ভরা জোছনার নিচে কল্পনা মেহবুবা আর বাস্তবের এ এক অপূর্ব মিশেল!
( বেলি ফুলের মালা আমি কখনো পাইনি, একটা চিরকুট পেয়েছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া হিসেবে সেটা আজীবন আমি সযতনে রাখব)
                                                 

Comments

Popular posts from this blog