গল্পঃ৭৫’এর আগন্তুক (অনুগল্প) 

লেখকঃআসিফ মাহমুদ জীবন

রাজনৈতিক দলের বড় একজন নেতা আলিম আলি। বহু বছরের সাধনা আর পরিশ্রমে আজ তার এই অবস্থান। বয়স তার পঞ্চাশ ছুইছুই হলেও সংসার জীবনটা একটু দেরিতে শুরু করেছিলেন তিনি, মোদ্দা কথা হল ঠিক সময় হয়ে ওঠেনি। নিজের ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। তার একমাত্র ছেলে আবির এবার ক্লাস ওয়ানে। স্কুলের কাছাকাছি আসতেই ফোন বেজে ওঠে। আলিম আলি ভ্রূ কুঁচকে ফোনের দিকে তাকান, কারণ তিনি জানেন তার কাছে ফোন আসা মানেই দলীয় কাজ , আর আলিম আলি ব্যাক্তিগত সময়ে এসব কাজ মোটেও পছন্দ করেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরেন তিনি। অপর প্রান্ত থেকে রাগিবের অতিরিক্ত ভক্তি সহযোগে কথা শোনা যায়-“ আসসালামু আলাইকুম স্যার, ভাল আছেন? আপনার শরীর স্বাস্থ্য ভাল? আপনার ছেলে ভাল আছে?”
অনেকটা ধমক দিয়েই আলিম আলি বলেন-“ কি বলবে বল...”
কাঁচুমাচু হয়ে যায় রাগিব, তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে-“ স্যার, কালকে ইয়ে কি জেন...অ হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। আমরা স্যার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি বনানীতে। অনুষ্ঠানে আপনি প্রধান অতিথি। আমরা বনানী থেকে গুলশান পর্যন্ত আনন্দমিছিল বের করব, আপনি গাড়িতে করে সেখানে অংশ নিলে আমরা খুব খুশি হব।“
আলিম আলির চোখ চকচক করে ওঠে, এমন সুযোগ ছাড়া তার মোটেও ঠিক হবে না। তিনি অনেকটা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বললেন-“ তোমরা তো জানই আমি ব্যাস্ত মানুষ। তারপরও যখন বলছ আমি চেষ্টা করে দেখব। “
রাগিব একগাল আনন্দ নিয়ে বলে- “ সে তো আমরা জানি, তবু আসার চেষ্টা করবেন , এ তো আপনার মেহেরবান। স্যার, একটা অনুরোধ, আসলে মিছিলের প্রতিপাদ্য কি হবে? একটু যদি আপনি বলে দিতেন...হে হে”
আলিম আলি বেশ খুশি হলেন, তারপর অনেকটা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বললেন-“ প্রতিপাদ্য হবে- আসুন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করি।“
ফোন কেটে দিলেন আলিম আলি, আজ মেজাজটা বেশ ফুরফুরে লাগছে তার।

“ স্যার একখান ফুল নিবেন?”
হটাত শব্দে ফিরে তাকান আলিম আলি। ৭-৮ বছরের এক ছেলে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেকিয়ে উঠলেন তিনি- “ দূর হ হারামজাদা, ফুল কি আমি আমার ইয়ে তে দেব" পাশে নিজের ছেলেকে দেখে ভাষা সংযত করলেন তিনি। আবির চোখ বড় বড় করে ফুলওয়ালা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে, বয়সে কিছুটা ছোটই হবে সে।
" স্যার একখান নেন, সক্কাল থেইকা কিচ্ছু খাই নাই।“
“ খাস নাই তো আমার কাছে কেন, আমারে কি সরকারি গুদাম পাইছিস?” নিজের ছেলেকে হাত ধরে টান দেন তিনি, স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নামাই ভুল হয়েছে। “ যতসব টুকাই এর দল!!” রাগে গজগজ করতে থাকেন আলিম আলি, আবির তার বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জগৎসংসারের এ দিকের সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।

আলিম আলি আনন্দমিছিলে অংশ নিয়েছেন। চলমান গাড়ির ছাদ থেকে তিনি হেসে হেসে হাত নাড়ছেন, কার দিকে নাড়ছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। মিছিলের সামনে ব্যানারে লেখা- আসুন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শিশু অধিকার নিশ্চিত করি। আলিম আলি একা আসেন নি, সাথে আবির কেও নিয়ে এসেছেন। সে আপাতত গাড়ির জানলা দিয়ে একটা ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কাঠ ফাটা রোদে র‍্যালির ভিতরে পানি বিক্রি করার চেষ্টা করছে। আলিম আলি মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেবার চেষ্টা করছেন, চেষ্টা করছেন কারণ এই কাঠফাটা রোদে তার গা দিয়ে ঘাম ছাড়া গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না।
“ আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী, এ দিন তিনি..................আজকের শিশু দিবসে আমরা চলুন শপথ করি প্রত্যেক শিশুর অধিকার আমরা তাদের বুঝিয়ে দেব। ভাইসব...” এ পর্যায়ে একটা হট্টগোল শোনা গেল, একজন নেতার মানিব্যাগ খোয়া গেছে। পাশে এক টুকাই ছেলে ছিল, আপাতত সন্দেহটা তার উপর পরেছে। নেতা মহাশয় এক চড় দিতেই তার চেলা চামুণ্ডা তাকে খুশি করার জন্য ছেলেটাকে রীতিমতো গণপিটুনি দেয়া শুরু করল। ছেলেটা আদেও জানে না তার অপরাধ কি, শুধু মাত্র আদিম অভ্যাসের বশে হাত দু খানা জড় করে” মাফ করে দেন” শব্দটাই শোনা যাচ্ছে। আলিম আলি রেগে গেলেন, “ মার,মার, হারামির কত বড় সাহস, মফিজ সাহেবের পকেট কাটে! আজ এদের জন্য দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। এমন সময় মফিজ সাহেবের পি এ কে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা যায়।
“ স্যার, আপনি গাড়িতে মানিব্যাগ ফেলে এসেছিলেন।“ নিরস মুখে মানিব্যাগ খানা নেন মফিজ সাহেব, অন্যদিকে গণপিটুনি চলছে কিন্তু কোন ভ্রূক্ষেপ দেখা যায় না তার মুখে। মানিব্যাগ পাওয়া গেছে খবর শুনে অনেকটা নিরাশ হয়ে যায় মফিজ আলির চেলারা, গণপিটুনি থামিয়ে লাথি মেরে ছেলেটাকে বের করে দেয় তারা। রক্তমাখা শরীর নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা, ঠোঁট কেটে অঝোরে রক্ত পড়ছে। অশ্রু মাখা চোখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যায় সে।
“ দুঃখিত, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আসুন আমরা শপথ করি শিশু অধিকার আমরা নিশ্চিত করবই...” আলিম আলি তার বক্তৃতা ফের শুরু করেন।

মঞ্চ থেকে কিছুটা দূরে গাড়ির পাশে এক দোকানের বেঞ্চে আবির বসে আছে। এতক্ষনে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার নজর এড়ায় নি। হটাত পাশে ফিরে আবির একজন ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখে। সাদা পাঞ্জাবির উপর ছোট কোট পরা। চোখের পুরু চশমার আড়ালেও তার চোখের অশ্রু বেশ টের পাওয়া যায়। লোকটা একটানা খুঁড়াতে খুঁড়াতে হেঁটে যাওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাল করে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে লোকটা বিড়বিড় করে বলেই চলেছে—“এমন বাংলাদেশই কি আমি চেয়েছিলাম! এমন বাংলাদেশই কি আমি চেয়েছিলাম!”

হটাত মনে হল আবিরের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়ে উঠেছেন। আবিরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছে তিনি লাজুক ভঙ্গিতে হাসলেন। আবিরের কেন জানি মনে হল সে লোকটাকে চেনে, বেশ ভালভাবে চেনে, কোথায় যেন দেখেছে। লোকটা কোন কথা না বলে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে চলে যাচ্ছে, তার মুখে বিষাদের ছায়া আবার ফিরে এসেছে।
বাড়িতে এসেই দৌড়ে রুমে গিয়ে বই খুলল আবির, এই তো, বইয়ের প্রথমেই লোকটার ছবি দেয়া আছে। আবির জোরে জোরে ছবির নিচের নামটা বানান করে পড়তে থাকে— “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। “

Comments

Popular posts from this blog