গল্পঃ তুলনা 

লেখকঃ আসিফ মাহমুদ জীবন

স্কুল মাঠের নিচু জমি থেকে কয়েক তাড়ি আড়ং শাকের পাতা তুলল রহিমা। ছেলেটা কয়দিন থেকেই মুরগির মাংস খেতে চাচ্ছে, কিন্তু রহিমা নিরুপায়। যেখানে দিনে দুবেলা ভাত যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব সেখানে মাংস তো অলীক কল্পনা। রহিমা বাড়ির দিকে ফিরছে, প্রচণ্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। গত কয়েক মাস ধরে বড় কয়টা ঝড় গিয়েছে রহিমার উপর। মাস ছয়েক আগে কাশেম মিয়া ট্রাক চাপায় মারা গেছে, স্বামীর লাশ চিনতে পারেনি রহিমা, অবশ্য সে বস্তুকে লাশ বলাও চলে না, একদলা মাংসপিণ্ড বললেই ভাল হয়। স্বামীর শোক কাটাতে না কাটাতেই দ্বিতীয় ঝড়টা আসলো, এবার বেশ জোরেশোরেই। রহিমার ছেলেটার ক্যান্সার ধরা পড়ল, ব্লাড ক্যান্সার। ছেলেটা দু মাসেই শুকিয়ে গেছে, অস্থিচর্মসার এমন শিশুকে দেখে যে কেউ চমকে মৃত ধরে নেবে, কিন্তু সুলেমান মরেনি, বেঁচে আছে। বেঁচে আছে মরে যাবার জন্য।

বাড়ির সামনের গলি দিয়ে না ঢুকে বড় রাস্তার দিক দিয়ে ঘুরে বাড়ি ঢুকল রহিয়া। গলিতে ঢুকলেই মরিয়ম চাচির সাথে দেখা হতো, গত একমাস ধরে চাচি ধারের টাকাটার জন্য তাগাদা দেয়া শুরু করেছে। দেখা হলেই দু চার কথা শুনিয়ে দিত। ঘরে ঢোকার পরও সুলেমান নড়ল না, দেহটা অসাড়ের মতো পরে আছে, শুধু চোখের চাহনি দেখে বোঝা গেলো মায়ের ফেরাটা সে টের পেয়েছে। সুলেমান প্রাণপণে চেষ্টা করছে মায়ের দিয়ে তাকানোর, পারছে না। সারা গায়ে অসহ্য জ্বলুনি হচ্ছে তার। রহিমা তাড়াতাড়ি গিয়ে সুলেমানের মাথার নিচে বালিশটা ঠিক করে দিয়ে পাশে বসল। বুকের সব কটা হাড় গোনা যাচ্ছে ছেলেটার, মুখটা হাঁ হয়ে আছে, চোখদুটো?চোখদুটো কত কি না জানি বলতে চাচ্ছে, বলতে পারছে না। সেসব অব্যাক্ত কথা চোখের কোণে জল হয়ে জমে আছে!রহিমা হটাত মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে ফেলল,নিজেকে দেখে মাঝে মাঝে মাঝে সে অবাক হয়, এতকিছুর পরও বেঁচে আছে কিভাবে সে!

চেয়ারম্যনের বাড়িতে কাজটা পেয়েছিল বলে রক্ষে। কাশেম মিয়া মারা যাবার পর চেয়ারম্যানের বউ দয়া করে ঝিয়ের কাজটা দিয়েছিল তাকে।আজকাল সে কাজেও যেতে ভয় লাগে। চেয়ারম্যানকে দেখে কত ভাল লোকই না মনে হয়!বৃদ্ধ মানুষ, মুখে কলপ করা লম্বা দাঁড়ি, কপালে সুন্নাতি দাগ বানিয়ে ফেলেছেন। অথচ সেদিন ঘর মোছার সময় চেয়ারম্যান যখন খপ করে তার হাত ধরেছিল তখন অবাক হয়ে বাবার বয়সি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়েছিল রহিমা, বৃদ্ধ বয়সেও চোখে কি লোভ!হাতটা ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে দৌড়িয়ে চলে এসেছিল সে, পৃথিবীটা এত খারাপ কেন!
সুলেমানের শরীরটা আজ খুব খারাপ,সকাল থেকে ছোট্ট দেহটা মোচড় মারছে, হাপরের মতো উঠানামা করছে বুক। মুখে অদ্ভুত গোঙানি শোনা যাচ্ছে, সে গোঙানি যে কতটুকু বেদনার সেটা আর কেউ না বুঝলেও রহিমা বুঝতে পারছে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার , সে কিছু বলতে পারছে না। পাশের বাড়ির জরিনা খালা চামচে করে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, পানিটা মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল ।দেহটা হটাত মোচড়ানো বন্ধ করে দিলো, চোখের মনি হয়ে গেলো ঘোলাটে।নির্বাক চোখের দিকে তাকিয়ে রহিমাও নিশ্চুপ হয়ে আছে, পৃথিবী তার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়েছে।
মসজিদের সামনে ছেলের লাশ কোলে নিয়ে বসে আছে রহিমা, মাঝে মাঝে মুখটা বাড়িয়ে ছেলের গালে চুমু খাচ্ছে সে। জুম্মার নামাজ ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে, ইমাম সাহেব জরিনা খালাকে কথা দিয়ে গেছেন জুম্মার নামাজে তিনি দাফন কাফনের জন্য লোকদের বলবেন। রহিমা মসজিদের সামনের অবাক হয়ে বসে আছে, চারপাশের মানুষের কথা সে বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছে না, ছেলেকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে, ছেলের শরীরটা এত ঠাণ্ডা লাগছে কেন তার!

বাবার হাত থেকে ১০ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে আগ্রহভরে ৪ বছর বয়সি মুনতাম বসে আছে। সুন্নত নামাজের পর মসজিদের টাকা সংগ্রহের কাজ চলছে। মুসল্লিরা যে যা এনেছিলেন টা মসজিদে দিয়ে দিচ্ছেন। ছোট্ট মুনতামের আর তর সইল না, সে উঠে গিয়ে এক সারি সামনের মুয়াজ্জিনের পুটলিটার মধ্যে টাকার নোটটা ঢুকিয়ে দিলো, তার মুখের হাসিটাই বলে দিলো সবার মতো টাকা দিতে পেরে সে কতটা খুশি। ফরজ নামাজের পর সব মুসুল্লিরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন ইমাম সাহেব সবাইকে লাশ দাফনে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে বললেন। মুসল্লিরা বাইরে এসে অবাক হয়ে দেখলেন একটা শিশুর লাশ জড়িয়ে পরম মমতায় পাণ্ডুর গালে চুমু খাচ্ছেন তার মা। অধিকাংশ মুসল্লিরা যে টাকা এনেছিলেন তা মসজিদে দিয়ে ফেলেছেন। মুনতাম বাবার হাত ধরে বের হওয়ার সময় দেখল তার বয়সি একটা ছেলে মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমুচ্ছে, হ্যাঁ, ঘুমুচ্ছেই তো। ইস! ওর কি লজ্জা করে না! মুনতাম হলে তো লজ্জাতেই মরে যেত!
আটটি টাকা হাতে নিয়ে মাটিতে বসে আছে রহিমা, ধীরে ধীরে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফরিয়াদের ভঙ্গীতে সে বলল,
“ হে আল্লাহ! তোমার অভাব বুঝি আমার থেকেও বেশি?”
( সমাপ্ত)
( ঘটনাটা আমার সামনেই দেখা,যেকটা টাকা নিয়ে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম তার সবটুকুই মসজিদে দিয়ে যখন অসহায় মা’ টাকে সামান্য সাহায্য করতে পারলাম না, নিজের কাছে নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছিল)
                                   

Comments

Popular posts from this blog